বর্তমান বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর মানচিত্রে এমন এক স্বাধীন রাষ্ট্র, যা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ নব্বই বছর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কলোনীরূপে শাসিত হয়েছে এবং তারও আগে পুরো একশ’ বছর এ ভূখণ্ড ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’ নামক একটি বিলাতি ব্যবসায়ী কোম্পানী ও তাদের কলকাতাকেন্দ্রিক দালাল সহযোগী শ্রেণীর মিলিত শোষণ ও লুণ্ঠনের ক্ষেত্র ছিল।
এ সময় সুদখোর মহাজনদের নিষ্ঠুর নির্যাতন এ অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের নিত্যদিনের ভাগ্যলিপিতে পরিণত হয়।
ঐতিহাসিক পটভূমি
এদেশের মানুষ দীর্ঘদিন উপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এবং তাদের দেশীয় লুটেরা সহযোগীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং
তাদের এ লড়াই-এ রাজনৈতিক আযাদী হাসিলের আকাঙ্ক্ষার সাথে জড়িয়ে ছিল তাদের বোধ ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার স্বপ্ন।
বিশ্বাসগত কারণে এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সুদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধমূলক মনোভাব গড়ে উঠেছে। সুদের বিরুদ্ধে তারা যুগ-যুগ ধরে সংগ্রাম করেছেন।
বাংলাদেশের ফকীর বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ, ফরায়েযী আন্দোলন এবং শেরে বাংলা ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির আন্দোলনে সুদ উচ্ছেদের দাবি ছিল সমুচ্চারিত।
সুদের বিরুদ্ধে জনগণের ঐতিহ্যগত ক্ষোভ ও ঘৃণার পরিচয় এদেশের নান কাহিনী ও উপাখ্যানে প্রকাশ পেয়েছে। সুদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণার কারণে এদেশে এ বিশ্বাস প্রচলিত হয়েছে যে, সাতজন সুদখোরের নাম লিখে গরুর গলায় ঝুলিয়ে দিলে সে গরুর ঘায়ের পোকা পড়ে যায়।
মহাজনী সুদের মতো প্রাতিষ্ঠানিক সুদের ব্যাপারেও জনগণের মনোভাব অভিন্ন।
সুদমুক্ত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা তাই এদেশের মানুষের বহু পুরনো প্রত্যাশা। সে আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ব্রিটিশ শাসনাধীন।
বাংলাদেশের কক্সবাজার ও যশোরসহ একাধিক এলাকায় সুদমুক্ত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার প্রচেষ্টার কথা জানা যায়। কিন্তু তৎকালীন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিতে সেসব উদ্যোগ স্থায়ী ভিত্তি অর্জন করতে পারেনি।
পাকিস্তান আমল
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীনতা ছিন্ন করে স্বতন্ত্র জাতিসত্তা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই এ ভূখণ্ডটিতে মেজরিটি জনগণের আদর্শিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে তাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ক্রমশ সংহত ও জোরদার হয়ে ওঠে।
১৯৪৮ সালের ১ জুলাই স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ব্যাংকের প্রথম গভর্নর জনাব জাহিদ হোসেন দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে শরীয়ার নীতিমালার ভিত্তিতে পুনর্গঠনের আহ্বান জানান।
এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সুদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে মত দেন।
১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ পাকিস্তান গণপরিষদে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের জন্য কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক ‘আদর্শিক মূলনীতি প্রস্তাব’ গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবে দেশের অর্থব্যবস্থা ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে পুনর্গঠনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
এরপর ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের উভয় অংশের ৩১ জন বিশিষ্ট আলিম করাচিতে চার দিনের সম্মেলন শেষে সর্বসম্মতভাবে ইসলামী শাসনতন্ত্রের জন্য ২২ দফা শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি প্রণয়ন করেন।
এর চতুর্থ দফায় ‘কুরআন-সুন্নাহ মুতাবিক মারূফ (সৎ) কার্যাবলি জারি করা, নিষিদ্ধ কার্যাবলি রহিতকরণ, ইসলামী রীতি-প্রথা ও আচার-আচরণের পুনরুজ্জীবন ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য’ বলে উল্লেখ করা হয়।
পাকিস্তান আমলের প্রায় সবটুকু সময় জুড়েই শাসনতান্ত্রিক বিতর্ক অব্যাহত থাকে । এই সময় ইসলামী বিধি-বিধান বাস্তবায়নের দাবি ক্রমশ জোরদার হয়। সুদমুক্ত অর্থনীতি ও ব্যাংক-ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি তার অংশ ছিল।
একাডেমিক ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ডক্টর এম এন হুদা, প্রফেসর ডক্টর কে টি হোসেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ডক্টর হাসান জামান, ভাষা সৈনিক প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম প্রমুখ এক্ষেত্রে সমধিক সোচ্চার ছিলেন।
রাজনীতির ময়দানে খেলাফতে রব্বানী পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি সংগঠন ইসলামী অর্থনীতির ব্যাপারে জনগণের দাবিকে জোরেশোরে উচ্চারণ করে।
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর ‘সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং’, ‘ইসলাম ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ’ প্রভৃতি বই বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করার ফলে এ ব্যাপারে সুধী জনগণের মনোযোগ অধিকতর আকৃষ্ট হয়।
এসব বই ছাড়াও মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীমের লেখা ইসলামী অর্থনীতি’ এদেশে ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং আন্দোলনের তত্ত্বীয় ভিত্তি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এ ভিত্তির উপরই এক্ষেত্রে লেখালেখি, আলোচনা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম প্রভৃতির মাধ্যমে জনসচেতনতা ক্রমশঃ জোরদার হয়ে ওঠে।
উলামায়ে কিরামের মধ্যে এক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারীদের মধ্যে মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমী ও শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ আমল : প্রস্তুতির পথে
মুসলিম বিশ্বে ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন শক্তিশালী হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তরকালে । ১২৯ শুরু ১৯৭৩ সালে। Bridally-1975 = 56 members
১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক বা আইডিবি’র চার্টারে স্বাক্ষর করে এবং নিজ দেশে ইসলামী শরীয়ার ভিত্তিতে অর্থনীতি ও ব্যাংকিং কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। জেদ্দা পদ্য প্রেসিডেন্ট – আহলে যো- আলী মাদানী।
১৯৭৬ সালে প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তানায়ক মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীমের নেতৃত্বে ঢাকায় “ইসলামিক ইকনোমিকস রিসার্চ ব্যুরো’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সংগঠন বাংলাদেশে ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার বিকাশ ও ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে।(বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)
১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসে সেনেগালের রাজধানী ডাকারে অনুষ্ঠিত ইসলামিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে ইসলামী ব্যাংকের সংজ্ঞা অনুমোদন করা হয় । বাংলাদেশ এ সম্মেলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে এ সুপারিশ অনুমোদন করে।
১৯৭৯ সালের নভেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব মোহাম্মদ মহসিন দুবাই ইসলামী ব্যাংকের অনুরূপ বাংলাদেশে একটি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য পররাষ্ট্র সচিবের কাছে লেখা এক চিঠিতে সুপারিশ করেন।
৺ এর পরপরই ডিসেম্বর মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং উইং বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিমত জানতে চায়।(বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে তৎকালীন গবেষণা পরিচালক জনাব এ এস এম ফখরুল আহসান ১৯৮০ সালে ইসলামী ব্যাংকসমূহের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার জন্য দুবাই ইসলামী ব্যাংক, মিসরের ফয়সল ইসলামী ব্যাংক, নাসের সোশ্যাল ব্যাংক এবং ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব ইসলামিক ব্যাংকস-এর কায়রো অফিস পরিদর্শন করেন।
১৯৮১ সালে তিনি বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে একটি প্রতিবেদন পেশ করেন।
১৯৮০ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ওআইসিভুক্ত দেশসমূহের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অধ্যাপক শামসুল হক সদস্য দেশসমূহের জন্য একটি আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন।
১৯৮০ সালের ১৫-১৭ ডিসেম্বর ইসলামিক ইকনোমিকস রিসার্চ ব্যুরোর উদ্যোগে ঢাকায় ইসলামী ব্যাংকিং-এর ওপর একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।(বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)
বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর জনাব নূরুল ইসলাম উক্ত সেমিনার উদ্বোধন করেন । তিনি তাঁর ভাষণে বাংলাদেশে একটি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।”
১৯৮১ সালের মার্চে ওআইসি দেশসমূহের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসমূহের গভর্নরদের সম্মেলন সুদানের খার্তুমে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে পেশকৃত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানান যে, বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।(বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)
১৯৮১ সালের এপ্রিল মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে লেখা এক পত্রে পাকিস্তানের অনুরূপ বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহের সকল শাখায়ও পরীক্ষামূলকভাবে পৃথক ইসলামী ব্যাংকিং কাউন্টার চালু করে এ জন্য পৃথক লেজার রাখার পরামর্শ দেয়া হয়।
১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসে ‘মক্কা’ এবং ‘তায়েফে’ অনুষ্ঠিত তৃতীয় ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সুপারিশ করেন : ‘মুসলিম দেশসমূহের উচিত তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণার আলোকে একটি স্বতন্ত্র ব্যাংক ব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার করা।’
এ ঘোষণা বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারের ইতিবাচক ও সক্রিয় মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
১৯৮১ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজে ইসলামী ব্যাংকিং-এর ওপর এক মাস স্থায়ী এক সার্বক্ষণিক আবাসিক প্রশিক্ষণ কোর্স অনুষ্ঠিত হয়।
এ কোর্সে বাংলাদেশ ব্যাংক, সকল রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংক, বিআইবিএম ও প্রস্তাবিত ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ব্যাংক অব ঢাকা লিমিটেড (বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড)-এর ৩৭ জন কর্মকর্তা অংশ নেন। সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল এম আযীযুল হক এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৮২ সালের ১৮ জানুয়ারী থেকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-এর উদ্যোগে ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে দ্বিতীয় প্রশিক্ষণ কোর্স অনুষ্ঠিত হয়।
সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন আর্থ- সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ইসলামী ব্যাংকিং-এর ওপর সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো হলো, ইসলামিক ইকনোমিক্স রিসার্চ ব্যুরো, ওয়ার্কিং গ্রুপ ফর ইসলামী ব্যাংকিং ইন বাংলাদেশ, বায়তুশ শরফ ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ইত্যাদি।
হিজরী চৌদ্দ শতকের সূচনালগ্নে মুহররম মাসের ১ তারিখে (২২ নভেম্বর ১৯৭৯) বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর আলহাজ্জ্ব এম খালেদের নেতৃত্বে ঢাকায় বাংলাদেশ ইসলামিক ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন (বিবা) কাজ শুরু করে।
ইতোপূর্বে সোনালী ব্যাংক স্টাফ ট্রেনিং কলেজে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যাংকারদের অনেকে বিবা-এর কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৮২ সালে এ সংগঠন ব্যাংকার, আইনজীবী, সাংবাদিক, বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন স্তরের লোকদের জন্য পাঁচটি প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করে।
১৯৮২ সালের নভেম্বর মাসে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেন। এ সময় তাঁরা বাংলাদেশে বেসরকারী খাতে যৌথ উদ্যোগে একটি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় আইডিবি’র অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন।
প্রতিনিধি দল সন্তোষ প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং-এর ওপর প্রচুর কাজ হয়েছে এবং শীঘ্রই এদেশে ইসলামী ব্যাংকিং চালু করার ব্যাপারে প্রক্রিয়া চলছে
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার ব্যাপারে ইসলামিক ইকোনোমিক্স রিসার্চ ব্যুরো’ (আইইআরবি) এবং ‘বাংলাদেশ ইসলামিক ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন’ (বিবা) অগ্রণী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তারা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিতব্য ইসলামী ব্যাংকসমূহের জন্য দক্ষ ব্যাংকারের শূন্যতা পূরণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদকে ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করে।
এছাড়া এদেশে ইসলামী ব্যাংকিং-এর পক্ষে জনমত গঠন ও সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে তারা সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং ওয়ার্কশপের আয়োজন করে।
মুসলিম বিজনেসমেন এসোসিয়েশন (বর্তমানে মুসলিম ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টস অ্যান্ড বিজনেসমেন এসোসিয়েশন) ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোক্তা-মূলধন সংগ্রহে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে প্রথম ইসলামী ব্যাংক উদ্বোধন
বহুমাত্রিক দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফসলরূপে ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম সুদমুক্ত ব্যাংক “ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।(বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)
এক্ষেত্রে ১৯ জন বাংলাদেশী ব্যক্তিত্ব, ৪টি বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান এবং আইডিবিসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের ১১টি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারী সংস্থা এবং সৌদি আরবের দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় উদ্যোক্তারূপে এগিয়ে আসেন।
১৯৮৩ সালের ২৮ মার্চ পর্যন্ত ‘ইন্টারন্যাশনাল ইসলামী ব্যাংক অব ঢাকা লিমিটেড’ নামে বাংলাদেশের প্রথম ইসলামী ব্যাংকের প্রস্তুতিমূলক কাজ করা হয় এবং এই নামেই তখন পর্যন্ত ব্যাংকের সাইনবোর্ড ও প্রচার পুস্তিকা ব্যবহার করা হয়। (বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)
আলহাজ্জ মফিজুর রহমান ২৯ মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। এরপর এ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে কার্যক্রম শুরু করে।(বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)
ব্যাংকের একটি চমৎকার মনোগ্রাম তৈরি করে দেন দেশের খ্যাতিমান শিল্পী ও ক্যালিগ্রাফার জনাব সবিহউল আলম।
১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ বুধবার সকাল নয়টায় অনাড়ম্বর পরিবেশে লাইসেন্সের শর্ত পূরণের জন্য ৭৫ নং মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় ব্যাংকের রেজিস্টার্ড অফিসে ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’-এর কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়।
ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে কোন আনুষ্ঠানিক দাওয়াতপত্র ছাপা হয়নি। শুধু পত্রিকায় খবর দেখে অনেক লোক এ অনুষ্ঠানে স্বতস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।(বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বায়তুশ শরফ-এর পীর সাহেব মাওলানা আব্দুল জব্বার, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর ডাইরেক্টর জেনারেল জনাব এএফএম ইয়াহিয়া, অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন সচিব ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের নির্বাহী সহ-সভাপতি জনাব কফিলউদ্দীন মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা পরিচালক জনাব এএসএম ফখরুল আহসান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর জনাব এম খালেদ, ঢাকার কালেক্টর অব কাস্টমস জনাব শাহ আব্দুল হান্নান, দৈনিক দেশ’-এর সম্পাদক জনাব সানাউল্লাহ নূরী এবং দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক জনাব আখতার-উল-আলমসহ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন।
ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আলহাজ্জ আব্দুর রাজ্জাক লস্করের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে জনাব এএফএম ইয়াহিয়া, জনাব এএসএম ফখরুল আহসান, জনাব কফিলউদ্দীন মাহমুদ, ব্যাংকের সাবেক প্রকল্প পরিচালক ও ভাইস চেয়ারম্যান জনাব আলহাজ্জ মফিজুর রহমান বক্তৃতা করেন।(বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)
অনুষ্ঠান উপস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট ও প্রথম প্রধান নির্বাহী জনাব এম আযীযুল হক।(বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)
৩০ মার্চ ব্যাংকের অনানুষ্ঠানিক উদ্বোধনী দিনে ৪৮টি হিসাব খোলা হয় এবং তাতে জমার পরিমাণ ছিল ৩৫ লাখ টাকা। ব্যাংকের প্রথম হিসাবটি খোলা হয় ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর নামে। (বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)
ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক জনাব এএফএম ইয়াহিয়া ফাউন্ডেশনের পক্ষে পঁচিশ লাখ টাকা জমা দিয়ে বাংলাদেশে ইসলামী শরীয়াহ্ মুতাবেক প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকে আল-ওয়াদিয়া নীতির ভিত্তিতে প্রথম হিসাবটি খোলার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন।(বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)
৩০ মার্চ থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত শুধু আল-ওয়াদিয়া চলতি হিসাবে টাকা জমা নেয়া হয়। এরপর ১৯৮৩ সালের ১২ আগস্ট সকালে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার প্রধান সড়কে বিশাল প্যান্ডেলের নিচে ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
১২ আগস্ট থেকে চলতি হিসাব ছাড়াও মুদারাবা পদ্ধতিতে প্রফিট-লস শেয়ারিং ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট বা পিএলএস সঞ্চয়ী হিসাব খোলা শুরু হয়।(বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং-এর বাস্তবায়ন
‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’-এর সফল অগ্রযাত্রার পথ ধরে পরবর্তীতে এদেশে আরও কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। (বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)
১৯৮৭ সালে ‘আল বারাকা ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরবর্তীতে ‘ওরিয়েন্টাল ব্যাংক’ এবং বর্তমানে ‘আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড’ নামে ব্যাংকটি পরিচালিত হচ্ছে।(বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)
১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে ‘আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড’ এবং ‘সোস্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৪ সালের ১ জুলাই থেকে সুদভিত্তিক ‘এক্সিম ব্যাংক’ তার কার্যক্রম ইসলামী পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করে।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে ফয়সাল ইসলামিক ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত হয় । পরবর্তীতে এর নাম হয় ‘শামিল ব্যাংক অব বারেইন’ (ইসলামী ব্যাংকার্স)। বর্তমানে এদেশে এই ইসলামী ব্যাংকটির কার্যক্রম নেই।(বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)
২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড’।
২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক সুদভিত্তিক ব্যাংকিং পরিহার করে ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়ে ‘ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড’ নাম ধারণ করে।(বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)
উল্লিখিত ৭টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক ছাড়াও ৯টি সুদভিত্তিক ব্যাংকের মোট ২০টি পৃথক ইসলামী ব্যাংকিং শাখা বর্তমানে কাজ করছে।
এক নজরে ইসলামী ব্যাংকিং শাখাধারী কনভেনশনাল ব্যাংকের শাখা সংক্রান্ত তথ্য
ব্যাংকের নাম
মোট শাখার সংখ্যা (ডিসেম্বর ২০০৯)
ইসলামী ব্যাংকিং
ইসলামী
শাখার সংখ্যা
ব্যাংকিং শুরু
প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড
৮৪
১৯৯৫
ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড
50
02
২০০৩
সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড
৫৬
ot
Good
দি প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড
৩৮
02
যমুনা ব্যাংক লিমিটেড
৫৪
২০০৩
দি সিটি ব্যাংক লিমিটেড
৯৭
২০০৩
এবি ব্যাংক লিমিটেড
৭৭
2008
এইচএসবিসি
১০
2008
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক
২৭
2008
মোট শাখার সংখ্যা :
250 2
20
(ডিসেম্বর ২০০৯)
১১৮৪
২০০৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পৃথক ইসলামী ব্যাংকিং শাখার পরিবর্তে কনভেনশনাল শাখার মধ্যেই ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডো’ খোলার লাইসেন্স প্রদান শুরু করে ।
এক নজরে ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডোধারী কনভেনশনাল ব্যাংকের তথ্য
ব্যাংকের নাম সোনালী ব্যাংক লিমিটেড
মোট শাখার সংখ্যা ইসলামী ব্যাংকিং
ইসলামী ব্যাংকিং শুরু
উইন্ডো সংখ্যা
ot
২৯ জুন ২০১০
অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড
৮৬৭
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০
পূবালী ব্যাংক লিমিটেড
৩৮৬
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড
৪১
02
02
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০
১৫ ডিসেম্বর ২০০৯
ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড
8 1
08
২৪ ডিসেম্বর ২০০৮
দি ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড
০২ জুলাই ২০০৮
মোট সংখ্যা :
২৫৬১
২৩
সফলভাবে ইসলামী ব্যাংকিং বাস্তবায়নের পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় ইসলামী ব্যাংকগুলো সম্মিলিতভাবে ২০০১ সালের ১৬ আগস্ট প্রতিষ্ঠা করে ‘সেন্ট্রাল শরীয়াহ্ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস্ অব বাংলাদেশ’।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ গত ০৯ নভেম্বর ২০০৯ ঈসায়ী তারিখে শরী’আহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ‘গাইডলাইন্স ফর ইসলামিক ব্যাংকিং’ শীর্ষক বিআরপিডি সার্কুলার নং ১৫/২০০৯ জারি করে।
বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠিত হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ হতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য প্রদত্ত এটাই প্রথম গাইডলাইন।(বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং)