ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ঐতিহাসিক ভূমিকা, বিশেষ করে বাংলাদেশে এর পটভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা যায়। আমার বিশেষ করে মনে পড়ে, আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম এবং একটি ছাত্র সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলাম তখন দু’টি প্রশ্ন মনে উদয় হতো এবং বিব্রত করতো।
এটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে যখন ঢাকা কলেজে ছিলাম তখনও হতো। একটি প্রশ্ন ছিল যে, ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় এবং যেহেতু ইসলামী শাসনতন্ত্র সম্ভব নয় সুতরাং একটি ইসলামী রাষ্ট্রও সম্ভব নয়।
যেহেতু ইসলামী সংগঠন থেকে বলা হতো যে, আমাদের দাবি হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র বা হুকুমাতে ইলাহিয়া অর্থাৎ খেলাফত কায়েম করা। খেলাফত অর্থ এই নয় যে, শুধু একজন খলিফা মনোনয়ন করা। খেলাফত মানে খেলাফত ব্যবস্থা কায়েম করা। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং: ঐতিহাসিক ভূমিকা।
এই খেলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল – যার মধ্যে মানবতা থাকবে, যার মধ্যে ইসলামের রাষ্ট্র ব্যবস্থার সকল বৈশিষ্ট্য থাকবে। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগতো যে, এটি সম্ভব নয়।
কিন্তু যখন পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়ে গেল এবং শাসনতন্ত্র দেশের আলিম সমাজও গ্রহণ করলেন তখন ইসলামী শাসনতন্ত্র তথা ইসলামী রাষ্ট্র সম্ভব নয় – এই প্রশ্ন সবার মন থেকে সরে গেল । যে ভাবনা সারাক্ষণ তাড়া করতো, ইসলামী শাসনতন্ত্র বা ইসলামী রাষ্ট্র একেবারেই সম্ভব নয় তা আর রইল না।
এমনকি আল্লাহ পাকের মেহেরবানীতে যে ব্যক্তি একসময় বলেছিলেন যে, ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সম্ভব নয়, সম্ভব হলে আপনারা প্রণয়ন করে দেখান, যখন ১৯৫২ সালে সকল মতের আলিম একত্রিত হলেন এবং তাঁরা ২২ দফা মূলনীতি তৈরি করে দিলেন তখন (এই ব্যক্তি মরহুম এ কে ব্রোহী) তিনি পরবর্তীকালে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার সমর্থক হয়ে দাঁড়ান এবং পরবর্তীকালে তিনি একজন ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবেই পরিচিত হয়ে যান। এটা ছিল একটা দিক।
দ্বিতীয় দিক যেটা লোকে মনে করত (আমাদের ছাত্র জীবনে), যেহেতু ইসলাম সুদকে স্বীকার করে না, সেহেতু ইসলামী ব্যাংক সম্ভব নয় এবং যেহেতু ব্যাংক সম্ভব নয় সুতরাং ইসলামী অর্থনীতিও সম্ভব নয় । কাজেই ইসলামী রাষ্ট্রের এই যে ধারণা, তা আমাদের পরিত্যাগ করা প্রয়োজন।
কিন্তু আল্লাহপাকের অসংখ্য মেহেরবানী, যে প্রশ্নটি আমাদেরকে বিব্রত করেছিল ১৯৭০ পর্যন্ত এমনকি ১৯৭৪-৭৫ পর্যন্ত – যখন ইসলামী ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম শুরু হয়ে গেল মধ্যপ্রাচ্যে এবং তারপরে যখন এ ধারণা বাংলাদেশে নিয়ে আসা হলো, এই ধারণা যখন ব্যাপক হলো এবং আল্টিম্যাটলি যখন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশে চালু হয়ে গেল, তখন থেকে লক্ষ্য করছি আমরা যে প্রশ্নে বিব্রত হচ্ছিলাম তা আর রইল না।
ব্যাংক যখন হয়ে গেল এবং কাজ শুরু করলো (১৯৮৩) এবং বাংলাদেশে যখন ইসলামী ব্যাংকের কাজের মাধ্যমে জনগণ দেখলো যে, ইসলামী ব্যাংক একটি প্র্যাকটিকেবল মাধ্যম এবং এরা ভালো করে একটি ব্যাংক চালাতে পারে, তারপর থেকে লক্ষ্য করছি, বাংলাদেশে ইসলামপন্থী লোকদের বিরুদ্ধে বা ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে বা ইসলামী আদর্শের বিরুদ্ধে যাই বলা হোক না কেন কিন্তু এ কথা আর বলা হচ্ছে না যে, ইসলামী ব্যাংক সম্ভব নয়।
এ কথা বলা হচ্ছে না যে, ইসলামী অর্থনীতি সম্ভব নয়। এটা যে কত বড় বিপ্লব তা আমরা অনুধাবন করতে পারছি না। আমরা যদি ঐতিহাসিকভাবে এটাকে দেখি পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়া এবং ইরানে ১৯৭৯ সালে শাসনতন্ত্র হয়ে যাওয়ার ফলে একটা মানসিক বিপ্লব সৃষ্টি হলো।
যার ফলে ইসলামী রাজনীতি, ইসলামী রাষ্ট্র, ইসলামী খেলাফত বা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্ভব নয় – এই যে ধারণা, তা চলে গেল।
এখন এ কথাটি তারা বলতে পারেন যে, আমরা ইসলামী শাসন ব্যবস্থা আমাদের জন্যে গ্রহণযোগ্য মনে করি না, এটা হলো অন্য প্রশ্ন । কিন্তু ইসলামী শাসন ব্যবস্থা সম্ভব নয়, ইসলামী অর্থনীতি সম্ভব নয় – এই অভিযোগ চলে না।
আল্লাহ পাকের অশেষ শুকরিয়া যে, ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা চালু হওয়ার কারণে বাংলাদেশে এবং বিশ্বব্যাপী এই চিন্তা নেই যে, ইসলামী অর্থনীতি অচল। যতটুকু মনে পড়ে, ১৯৯৪ সালের ৬ আগস্ট সংখ্যায় ইকোনোমিস্টে ‘সার্ভে অব ইসলাম’ নামে একটি দশ-বারো পৃষ্ঠার লেখা প্রকাশিত হয়েছিল।
তাতে তারা অনেকটা বিস্তৃত আলোচনা করে, সেটা আমাদের অনেকের দেখা দরকার ছিল। তারা সে লেখায় বলে যে, দুইটি জিনিস এখন আমরা ইসলাম থেকে নিতে পারি। তার মধ্যে একটি হলো, আমরা ইসলামী ব্যাংকিং নিতে পারি।
তার মানে তারা মেনে নিয়েছে যে, ইসলামী ব্যাংকিং ইজ সুপিরিয়র টু কনভেনশনাল ওয়েস্টার্ন মডার্ন ব্যাংকিং। কারণ ওয়েস্টার্ন মডার্ন ব্যাংকিংয়ের যে সঙ্কীর্ণতা বা অসুবিধা অথবা অন্যভাবে বলা যায় যে, ওয়েস্টার্ন মডার্ন ব্যাংকের যে সুবিধা তার চেয়ে অতিরিক্ত কিছু সুবিধা আছে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায়।
মুদারাবা, মুশারাকা, বাই মুয়াজ্জাল-এসব ভালো ভালো ব্যবস্থা রয়েছে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যা তারা গ্রহণ করেছে। এ প্রসঙ্গে তারা যুক্তি দেখিয়েছে যে, অতীতে আমরা ইসলাম থেকে ইউনিভার্সিটির আইডিয়া নিয়েছিলাম।
স্পেন, আন্দালুসিয়া থেকে আধুনিক শিক্ষা-সংস্কৃতির অনেক উন্নত বিষয়ের আইডিয়া নিয়েছিলাম। এখন আমরা ইসলামী ব্যাংকিংয়ের আইডিয়াও গ্রহণ করতে পারি।
এই আলোচনার সারসংক্ষেপ বলতে পারি বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং এর ইম্প্যাক্ট এটা হয়েছে যে, তারা ট্রেড ফাইন্যান্স করতে পেরেছে এবং ফাইন্যান্স সফলভাবেই করেছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স করেছে সফলভাবে। ট্রেড ফাইন্যান্স মুরাবাহার ভিত্তিতে, বাই মুয়াজ্জালের ভিত্তিতে করেছে।
তারা রুরাল ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রেও একটা বড় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তাই ইসলামী ব্যাংকিং এদেশে মোটামুটি সফল -এটা আমাদের স্বীকার করতে হবে । ক্যাশ ওয়াকফ (সোস্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক লিঃ) ব্যবস্থায় ক্যাশ নামে যে ধারণাটি নিয়ে আসছে, এটি হিস্টোরিক্যাল।
ইসলামী অর্থনীতিতে এটা আছে, সেটা এরা নিয়ে এসেছে। আপনি আপনার ক্যাশ যেমন ধরুন এক লক্ষ টাকা ওয়াকফ করে দিতে পারেন এবং ব্যাংককে নির্দেশ দিতে পারেন যে, এটা এই এই খাতে বা কর্মে এভাবে ব্যয় করতে হবে। ইসলামের এই চালু নেই ব্যবস্থাটাও বর্তমানে তারা চালু করেছে।
বাংলাদেশে লক্ষ্য করছি ইসলামী অর্থনীতির পরিভাষাসমূহ আস্তে আস্তে পরিচিত হয়ে যাচ্ছে। যেমন আজকে অনেক লোক জানে যে, মুশারাকা কি, মুরাবাহা কি, মুদারাবা কি । একটা সময় ছিল যে, এগুলো আমি নিজেও জানতাম না।
আমি ইসলামী মুভমেন্ট করি ১৯৫৭ থেকে কিন্তু আমি ইসলামী ইকোনমির এই টার্মগুলো সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত। অথচ এই সময় পর্যন্ত আমি ইসলামী মুভমেন্টে ছিলাম। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের লোকেরা এগুলোর সঙ্গে আমাকে পরিচিত করাননি।
এটা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে। আলিমরাও করাননি। কোনো খুতবাতেও আমি কোনদিন শুনিনি আলিমরা কোনদিন কোনো খুতবায় বলেছে যে, মুশারাকা কি, মুদারাবা কি, বাই মুয়াজ্জাল কি? এটাও তো আলিমদের তথা সমাজের একটা ব্যর্থতা।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং: ঐতিহাসিক ভূমিকা
দুশো, তিনশো বছর ধরে আমরা জনগণকে ইাসলামের পরিচিত টার্মগুলো, বিজনেস টার্মগুলোর সঙ্গে পরিচিত করাতে পারিনি। কাজেই মুসলমান হয়েও কত অন্ধত্বের মধ্যে যে অনেকেই আছেন তা কিন্তু তারা জানেন না।
আজকে এই ইসলামী টার্মগুলো পরিচিত হয়ে গেছে। যদিও এগুলোর সম্পর্কে একটা প্রপাগান্ডা আছে (ট্রেডিং মোডটা তারা বুঝতে পারে না)। ব্যবসায় লাভ আর সুদের টাকার উপর টাকা দেয়া যে এক জিনিস নয়, এটা তারা এখনো বুঝতে পারে না। তারা অনেকেই বলেন যে, আমরা একটু ঘুরিয়ে খাই এই যা।
এই ভ্রান্ত ধারণাটাও আমাদের প্রচারের মাধ্যমে, আলোচনার মাধ্যমে দূর করতে হবে। এলিটরা ইসলামী টার্মগুলো মেনে নিয়েছেন। এই দেশে যারা সবচেয়ে বড় পুঁজিপতি, একশ’ কোটি, দুইশ’ কোটি টাকার মালিক তারাও আজকে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সাথে আগ্রহ ভরে অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন।
এলিটরা বুঝেছেন যে, এটা সুবিধাজনক, এতে কোনো অসুবিধা নেই । সুতরাং, আমি মনে করি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আমরা একটা বিরাট কাজ করেছি।
যারা এই আন্দোলনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তারা খুব বড় এবং মহান কাজ করেছেন বলে আমি মনে করি। এটা ইসলামের স্বপক্ষে সবচেয়ে বড় পজিশন এনে দিয়েছে। ইসলামী মুভমেন্টের ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা ছিল ইসলামী ইকোনমি । এই বাধাটাই তারা দূর করে দিয়েছেন।
সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে আমাদের যে অভিজ্ঞতা, আমি যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ছিলাম তখন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ সমসাময়িক অন্যান্য ব্যাংকের মধ্যে রেটিংয়ের দিক থেকে নাম্বার ওয়ান ব্যাংকে পরিণত হয়।
ইসলামের আদর্শ হলো নম্র, ভদ্র এবং শালীনতার আদর্শ। সেটা ছিল আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের। এই আদর্শ দিয়ে আমাদেরকে জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবে।
এরপরও আমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই যে, ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাত্র শুরু বলা যায় । তবুও এটা বর্তমানে যে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে তাতে তারা এদেশের অর্থনীতি ও জনগণের ভাগ্য অনেকটা বদলে দিতে পারবে।
ইসলামী অর্থনীতির ভিত্তি দাঁড়ানোর কাজ এই ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার দ্বারা হয়েছে। এটা যে কত বড় একটা কাজ তা আমি ভাষায় বলতে পারবো না।
আসলে আগে আমাদের বুঝতে হবে যে, ব্যাংকিং কি? আগে ব্যাংকিং, তারপর ইসলামী ব্যাংকিং। আগে রাষ্ট্র, তারপর ইসলামী রাষ্ট্র। আগে মানুষ, তারপর ইসলামী মানুষ।
এখন ব্যাংকিং না বুঝলে সমস্যা হবে। ব্যাংকস আর ডিলিং উইথ দ্য পিপলস মানি – জনগণ কি চায়, এটা আপনাকে আরো জানতে হবে। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং: ঐতিহাসিক ভূমিকা।
আপনি ভালো ব্যবসা করবেন, সঠিক ব্যবসা করবেন এবং ইসলামী আদর্শ অনুসারে করবেন, করে যতটা প্রফিট সম্ভব করবেন। এটা জনগণের মতামত। এটা ইসলামবিরোধী নয়। সুতরাং, আপনাকে সমন্বয় করতে হবে প্রফিট এবং আদর্শের।
আরো পড়ুন: ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা