কুড়ি শতকের ষাটের দশকে মিসরের মিটগামার থেকে যাত্রা শুরু করে ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা মাত্র অর্ধ শতাব্দীর কম সময়ের মধ্যেই তার স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যকে বিশ্বব্যাপী সুস্পষ্ট করতে এবং সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়েছে। বাংলাদেশেও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।
বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্রকাঠামো ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বেসরকারী পর্যায়ে ইসলামী ধাঁচে আর্থিক পুনর্গঠনের একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং এখন আর শুধু তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয় নয়। মুদারাবা, মুশারাকা, বাই মুরাবাহা, বাই মুয়াজ্জাল, বাই সালাম প্রভৃতি পরিভাষা এখন এদেশের লাখো মানুষের দৈনন্দিন বাস্তব আর্থিক লেনদেনের ভাষা হিসেবে চালু হয়েছে।
তিন দশকের কম সময়ের মধ্যে দেশের সমগ্র ব্যাংকিং কার্যক্রমের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এখন ইসলামী শরীয়াহভিত্তিক পদ্ধতির আওতায় এসেছে। ইসলামী ব্যাংকিং-এর বিস্তৃতির সাথে সাথে এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা ও গবেষণা বিস্তৃত হচ্ছে।
মুসলিম বিশ্বে ইজতিহাদ বা গবেষণার যে ধারাটি স্তিমিত হয়ে পড়েছিল, ইসলামী ব্যাংকিং সেখানে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে। ইসলামী ব্যাংকিংকে কেন্দ্র করে ইজতিহাদ বাংলাদেশেও একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে চলেছে।
ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার এ পরিচালনগত সফলতা সকলের সামনে এ বিষয়টি আবার স্পষ্ট করেছে যে, আধুনিক বিশ্বের মানুষ সুদের মতো ক্ষতিকর উপাদানসমূহ বর্জন করেই তাদের সকল কার্যক্রম সফলভাবে সম্পাদন করতে পারেন। এদিক থেকে ইসলামী ব্যাংকিং নতুন আস্থা ও আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে।
ক. ইসলামী ব্যাংকগুলো অর্থব্যবস্থাকে সুদমুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। এক্ষেত্রে তাদের সাফল্য জনমনে একটি নতুন আশ্বাস ও আশাবাদ সঞ্চার করেছে।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
খ ইসলামী ব্যাংক তার বিনিয়োগ কার্যক্রমের মাধ্যমে সম্পদ কেবল মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত করার সনাতনী সুদী ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে একটি নতুন মডেল ধীরে ধীরে গড়ে তুলছে।
ইসলামী ব্যাংক তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জনগণের বিপুল সাড়া ও সমর্থন লাভ করেছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর সার্বিক পরিচালনগত সফলতা এদেশে নতুন ৪টি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহিত করেছে।
কয়েকটি বিদেশী ব্যাংকসহ প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোও ইসলামী ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডো খুলতে এগিয়ে এসেছে। দুইটি সুদভিত্তিক ব্যাংক ইতোমধ্যে ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংক হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে এবং আরো কয়েকটি ব্যাংক এই লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে।
শুরুর দিকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এককভাবে সম্পূর্ণ নতুন একটি সিস্টেম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নানামুখী কঠিন সমস্যা মুকাবিলা করেছে এবং এক্ষেত্রে একটি মডেল উপস্থাপন করতে সমর্থ হয়েছে।
প্রথম ইসলামী ব্যাংকটির কষ্টার্জিত অভিজ্ঞতা পরবর্তীদের পাথেয় হয়েছে। এখন সবক’টি ব্যাংক পারস্পরিক সহযোগিতা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে আরো দৃঢ়ভাবে সামনে অগ্রসর হতে পারবে বলে আশা করা যায়।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত চিত্র
এখানে বাংলাদেশের ৭টি ইসলামী ব্যাংকের মোট ৫২০টি শাখা এবং ৭টি সুদী ব্যাংকের ১৮টি ইসলামী শাখার কার্যক্রমের (৩১ ডিসেম্বর ২০০৯ ঈসায়ী তারিখে সমাপ্ত বছর পর্যন্ত) একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র’ দেয়া হলো :
ইসলামী ব্যাংক
ক্রমিক নং | ব্যাংকের নাম | প্রতিষ্ঠার বছর | শাখা সংখ্যা | মোট জনশক্তি | মোট আমানত | মোট বিনিয়োগ | লাভ-লোকসান |
০১ | ইসলামী ব্যাংক বাং লিঃ | ১৯৮৩ | ২৩১ | ৯৫৮৮ | ২৪৪২৯২ | ২৩৯০০০ | ৬৫১৮ |
০২ | আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক | ১৯৮৭ | ৩২ | ৭১৩ | ১৩০৪৬ | ১৩৪১০ | (-) |
০৩ | আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক | ১৯৯৫ | ৬০ | ১২৯৬ | ৩৮৩৫৫ | ৩৬১৩৪ | ১৭৪৯ |
০৪ | সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক | ১৯৯৫ | ৪২ | ৯৬৫ | ৩১৫৮৮ | ২৪৯৩৮ | ১১০২ |
০৫ | শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক | ২০০১ | ৫১ | ১২৯৯ | ৪৭৪৫৯ | ৪৩৯৫৮ | ২০৪১ |
০৬ | এক্সিম ব্যাংক | ২০০২ | ৫২ | ১৪৪০ | ৭৩৮৩৫ | ৬৮৬১০ | ৩২০৩ |
০৭ | ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক | ১৯৯৯ | ৫২ | ৯৯৫ | ৪২৪২৩ | ৩৮৭২৬ | ৭৬৬ |
মোট= | ৫২০ | ১৬২৯৬ | ৪৯০৯৯৮ | ৪৬৪৭৭৬ | ১৫৩৭৯ |
সুদভিত্তিক ব্যাংকসমূহের ইসলামী ব্যাংকিং শাখা
ক্রমিক নং | ব্যাংকের নাম | প্রতিষ্ঠার বছর | শাখা সংখ্যা | মোট জনশক্তি | মোট আমানত | মোট বিনিয়োগ | লাভ-লোকসান |
০১ | প্রাইম ব্যাংক | ১৯৯৫ | ৫ | ৯৩ | ১২৬৭৭ | ৯৪২৮ | ৬৪০ |
০২ | ঢাকা ব্যাংক | ২০০৩ | ২ | ২৫ | ৪৩৫৯ | ২২৫৫ | ১২৮ |
০৩ | সাউথইস্ট ব্যাংক | ২০০৩ | ৫ | ১০৩ | ১০৩০৭ | ৪৮৪২ | ৩১২ |
০৪ | প্রিমিয়ার ব্যাংক | ২০০৩ | ২ | ৩২ | ৩৩৫৬ | ১২৬৬ | ৫৪ |
০৫ | যমুনা ব্যাংক | ২০০৩ | ২ | ৪৪ | ২৩৬৬ | ২৭৫০ | ১৫৮ |
০৬ | সিটি ব্যাংক | ২০০৩ | ১ | ২৫ | ৭৬৮ | ৬৯৪ | ৪৫ |
০৭ | এবি ব্যাংক | ২০০৫ | ১ | ১৭ | ৩০৮৪ | ১৭৫৬ | ১৯২ |
মোট= | ১৮ | ৩৩৯ | ৩৬৯১৭ | ২২৯৯১ | ১৫২৯ | ||
সর্বমোট= | ৫৩৮ | ১৬৬৩৫ | ৫২৭৯১৫ | ৪৮৭৭৬৭ | ১৬৯০৮ |
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ৩১.১২.২০০৯ তারিখে মোট জমার পরিমাণ ছিলো ৩০৪২.৮৩ বিলিয়ন টাকা। তার মধ্যে সুদভিত্তিক ব্যাংকসমূহের ইসলামী ব্যাংকিং শাখাসহ ইসলামী ব্যাংকসমূহের মোট জমা ছিলো ‘৫২৭৯১৫.০০ মিলিয়ন টাকা।
এটি দেশের মোট জমার শতকরা ১৭.৩৫ ভাগ। দেশীয় অর্থনীতিতে এ সময় মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিলো ২৫৩১.১০ বিলিয়ন টাকা। তার মধ্যে ইসলামী ব্যাংকসমূহের বিনিয়োগ ছিলো ৪৮৭767.00 মিলিয়ন টাকা, যা মোট বিনিয়োগের শতকরা ১৯.২৭ ভাগ।
প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড, ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড, সিটি ব্যাংক লিমিটেড, প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড, এবি ব্যাংক লিমিটেড, সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড ও যমুনা ব্যাংক লিমিটেড তাদের বর্তমান সংগঠন কাঠামোর মধ্যেই পৃথকভাবে ইসলামী ব্যাংকিং শাখা খুলেছে।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ও অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড এবং বেসরকারী খাতের পূবালী ব্যাংক লিমিটেডসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংক তাদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সুদভিত্তিক কনভেনশনাল শাখার অভ্যন্তরে ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো চালু করেছে।
এসব ইসলামী ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডো ইসলামী শরীয়াহ্র নীতিমালা অনুসারে ব্যাংকিং সেবা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করছে। জমা সংগ্রহ ও বিনিয়োগ কার্যক্রমে উল্লিখিত শাখা/উইন্ডোসমূহের উন্নয়নধারা সন্তোষজনক।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
জমা সংগ্রহে ইসলামী ব্যাংকের সাফল্য

ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা ইসলামী অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। সেদিক থেকে এ ব্যাংকের আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য স্বতন্ত্র। ফলে ইসলামী ব্যাংকের কর্মকৌশল এবং তার জমা সংগ্রহ ও বিনিয়োগসহ সকল কার্যক্রমের উপকারভোগী শ্রেণী প্রচলিত অন্যান্য ব্যাংক থেকে বহুলাংশে ভিন্নতর এবং সার্বিকভাবে ব্যাপকতর।
ব্যষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা অর্জনের উদ্দেশ্যে ইসলাম জাতীয় সঞ্চয়কে বিশেষ গুরুত্ব দেয় এবং জনগণকে সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে উৎসাহ যোগায়।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
ইসলামী ব্যাংক এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে শুধু বড় সঞ্চয়ের প্রতি আগ্রহী না হয়ে ছোট জমাকারীদের সম্পদকে জাতীয় আর্থিক প্রবাহে নিয়োজিত করতে বাধ্য। এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ভূমিকা আলোচনা করা যায়।
মাত্র ১০০ টাকা প্রাথমিক জমা দিয়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এ আইনানুগভাবে যে কেউ হিসাব খুলতে পারেন। এভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় সংগ্রহে ইসলামী ব্যাংক গণ-ব্যাংক (mass bank)-রূপে ভূমিকা পালন করছে। ‘সঞ্চয়- বিনিয়োগ-আয়’ অর্থনীতির এই চক্র অনুসরণ করে ইসলামী ব্যাংক নিম্নবিত্ত মানুষের সামর্থ বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে।
এ লক্ষ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ নিঃ পল্লী এলাকার নানা জায়গায় তার শাখা ছড়িয়ে দিয়েছে। দেশের বেসরকারী ব্যাংকসমূহের মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ-এর গ্রামভিত্তিক শাখার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। অন্যান্য ইসলামী ব্যাংকও দেশের বিভিন্ন স্থানে শাখা সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
ইসলামী ব্যাংক মনে করে, সঞ্চয়ের মাধ্যমে একজন গ্রাহক ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে পারেন এবং সেইসাথে তিনি সামাজিক দায়িত্বও পালন করতে পারেন।
ইসলামী শরীয়তের মুদারাবা বা অংশীদারী সম্পর্কের ভিত্তিতে জনগণের কাছ থেকে জমা গ্রহণ এবং তা শরীয়তসম্মত পদ্ধতিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক তাদেরকে হালাল মুনাফা অর্জনে সহযোগিতা করছে।
সুদের কারণে যারা আগে ব্যাংকে অর্থ জমা করতেন না ইসলামী ব্যাংক সেই বিপুলসংখ্যক মানুষের অলস অর্থ জাতীয় অর্থনীতির মূলধারায় সঞ্চালিত করার সুযোগ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় অর্ধশত ব্যাংকের মোট প্রায় ছয় হাজার শাখা কাজ করছে। তার মধ্যে ইসলামী ব্যাংকসমূহের মোট শাখার সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচশ’। ইসলামী ব্যাংকিং শাখাগুলো গ্রাহক আকর্ষণের দিক দিয়ে বিপুল সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ২০০৯ সাল নাগাদ তার ২৩১টি শাখার মাধ্যমে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন গ্রাহককে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছে। এটি বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং-এর বিশেষ জনপ্রিয়তার একটি প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
আদর্শিক বিবেচনা ছাড়াও উন্নততর গ্রাহক সেবা ইসলামী ব্যাংকের জমা প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করছে। এ ব্যাপারে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড- এর জমা সংগ্রহের ওপর জরিপ চালিয়ে ড. মিহির কুমার রায় উপসংহারে মন্তব্য করেছেন :
The customer who are trying to avoid interest strongly support this system of banking. Not only religious injunction but also better banking services of IBBL have been influencing the customers’ preference to a great extent. Accordingly, IBBL is able to mobilise a great bulk of deposits.
জাতীয় সঞ্চয় আহরণে এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে ইসলামী ব্যাংকসমুহের সামর্থ্য ও নীট অবদান সুদী ব্যাংকের তুলনায় অনেক বেশি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় ইসলামী ব্যাংকগুলোর জমার ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছে।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
ইসলামী ব্যাংক কর্তৃক বেশি হারে সঞ্চয় আহরণের ফলে জাতীয় আর্থ-সামাজিক খাতে সুদের নেতিবাচক প্রভাব কমছে এবং ইসলামী ব্যাংকিং-এর ইতিবাচক অংশীদারিত্ব ক্রমশ বাড়ছে।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন সঞ্চয় স্কীমের দিকে তাকালেও এক্ষেত্রে তাদের সামাজিক লক্ষ্য ও তার অবদান স্পষ্ট হবে। যৌতুকের মত অপরাধ নির্মূলে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং বিবাহিত পুরুষদের ‘মোহর’ আদায়ে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ব্যাংকিং জগতে প্রথমবারের মত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ মুদারাবা মোহর সঞ্চয় হিসাব চালু করেছে।
নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়নে এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ। আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক এবং সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকও মুদারাবা বিবাহ সঞ্চয় প্রকল্প চালু করেছে। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক পৃথক মুদারাবা দেনমোহর সঞ্চয় স্কীমও চালু করেছে।
ওয়াকফ সম্পত্তি একসময় এদেশের সামগ্রিক জনকল্যাণমূলক কর্মসূচীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো । বর্তমানে নিরুৎসাহিত এ ধারাটিকে বেগবান করার উদ্যোগ নিয়েছে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিঃ এবং পরবর্তীতে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ ও আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিঃ।
কর্মব্যস্ত বিত্তশালী ব্যক্তিগণকে সামাজিক দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ ও আগ্রহী করা এবং এ কাজে তাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দেয়ার জন্য উদাহরণস্বরূপ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ-এর মুদারাবা ক্যাশ ওয়াক্ফ ডিপোজিট স্কীম’-এর প্রসঙ্গ আলোকপাত করা যায় ।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
এই স্কীমের আওতায় ওয়াক্ফকৃত অর্থের মুনাফা ৩০টি সামাজিক খাতে বিতরণের জন্য ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ এর নিজস্ব উদ্যোগ রয়েছে। গ্রাহক সে উদ্যোগে অংশ নিতে পারেন অন্যথায় এ হিসাবের লাভের অর্থ গ্রাহকের নির্দেশিত স্থানে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব ব্যাংক পালন করে ।
বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংকের ১ থেকে ২৫ বছর মেয়াদী হজ্জ সেভিংস স্কীম এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে একজন সাধারণ আয়ের মানুষও জীবনে একবার হজ্জ পালনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেন।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ কার্যক্রমের অর্থনৈতিক বিবেচনা
ইসলামের দৃষ্টিতে জনগণই হলো সকল উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। উন্নয়ন সমাজের সকল মানুষের জন্য। সুদী লেনদেনের নীতি ও কৌশল এর বিপরীত। ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থায় বিনিয়োগ পদ্ধতি সুদমুক্ত হওয়ার কারণে তা সুদের বহুমাত্রিক ও জটিল উপসর্গ থেকে মুক্ত।
পূর্বনির্ধারিত সুদের হার এবং জমার সুদ ও ঋণের সুদের মধ্যকার পূর্বনির্ধারিত ব্যবধানের কারণে সুদী ব্যাংকের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ নানাভাবে নিরুৎসাহিত হয়।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগকৃত অর্থের কোন পূর্বনির্ধারিত তহবিল-মূল্য (Prefixed cost of fund) না থাকায় ইসলামী ব্যাংকিং-এর ক্ষেত্রে উদ্যোক্তার চাহিদা না মেটা পর্যন্ত বিনিয়োগ অব্যাহত রেখে কাম্য মানের বিনিয়োগ ( investment equilibrium) নিশ্চিত করা সম্ভব।
এর ফলে উদ্যোক্তাগণ সমাজের জন্য কল্যাণকর কোন কম লাভজনক প্রকল্প গ্রহণেও নিরুৎসাহিত হন না। এটি ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
সমাজে বেকারত্ব দূর করতেও এটিই একমাত্র কার্যকর পদ্ধতি। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জেমস কিনস্ তার ‘থিওরি অব ইন্টারেস্ট’ প্রবন্ধে বলেছেন :
‘কোন অর্থনীতিতে পূর্ণ কর্মসংস্থানের জন্য সুদের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে।’
এ মন্তব্য ইসলামের সুদমুক্ত নীতিরই প্রতিধ্বনি। অধিক বিনিয়োগ অধিক উৎপাদন ও অধিক কর্মসংস্থানের সাথে সাথে অধিক রফতানিও নিশ্চিত করে । এতে বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার আন্তপ্রবাহ বাড়ে।
অধিক রফতানি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা (exchange rate stability) বজায় রাখতে সহায়তা করে। ফলে স্থানীয় মুদ্রার মূল্য বৃদ্ধি পায়। আমদানি মূল্য পরিশোধে তা অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করে এবং অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
এই আলোকে ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ কার্যক্রম বিচার্য। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ-এর মোট বিনিয়োগ ছিল ২৩,৯০০.০০ কোটি টাকা।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
২০১০ সালের জুন পর্যন্ত তা আরো ১৬১৭৮ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৫,৫১৭.৮০ কোটি টাকায়। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২,৪৯৩.৮০ কোটি টাকা।
অন্যদিকে এ সময়ে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩,৬১৩.৪০ কোটি টাকা ।
একই সময়ে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৪,৩৯৫.৮০, ৬,৮৬১ ও ৩,৮৭২ কোটি টাকা।
অন্যান্য দেশীয় কনভেনশনাল ব্যাংকের ইসলামী ব্যাকিং শাখাসমূহের সর্বমোট বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২,৩০০ কোটি টাকা।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
ইসলামী ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদেরকে শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি কৌশলগত ও ব্যবস্থাপনাগত প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয় এবং এ ব্যাপারে নিয়মিত তত্ত্বাবধান করে।
ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ টাকার পরিবর্তে সরাসরি পণ্যের সাথে যুক্ত। অর্থাৎ ইসলামী ব্যাংক টাকার বেচাকেনা করে না; পণ্যের ব্যবসায় অংশ নেয়। সুতরাং তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত (Diversion of Fund) হওয়ার সুযোগ থাকে না।
ফলে বিনিয়োগ মন্দ হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস পায়। ইসলামী পদ্ধতির বিনিয়োগের এটিও একটি ইতিবাচক দিক। দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ করা যায়, ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত বছরে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর খেলাপী বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩% এরও কম।
দেশের সামগ্রিক ব্যাংকিং সেক্টরের পরিস্থিতির তুলনায় শুধু নয়, আন্তর্জাতিক মানেও এ অবস্থা অত্যন্ত সন্তোষজনক। এটিও ইসলামী ব্যাংকিং-এর সম্পদ ব্যবস্থাপনার অন্তর্নিহিত শক্তির বহিঃপ্রকাশ।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগের উপকারভোগী কারা
২০০৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ৫ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ২,৩১,৪৩৬ জন, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৩৮৭৩ জন, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৮১ জন, এক্সিম ব্যাংকের ২৭০৬ জন।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর গ্রাহকসংখ্যা ছিল ৯,৩৬৭ জন, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৮৮ জন, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ১৬৯ জন এবং এক্সিম ব্যাংকের ছিল ৯৮৮ জন।
১০ লাখ থেকে ২৫ লাখ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক ৪,৮৯৫ জন, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের এই অংকের বিনিয়োগ গ্রাহক ছিল ১৭৭৫ জন, এক্সিম ব্যাংকের ছিল ৬১৯ জন এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ছিল ১৮৩ জন।
২৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের ১,৫৩৮ জন, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ছিল ৮০৯ জন, এক্সিম ব্যাংকের ৩৩৮ জন, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৫ জন।
ইসলামী ব্যাংকের ৫০ লাখ টাকার ওপর বিনিয়োগ গ্রাহকের সংখ্যা ছিল মাত্র ৯৭৪ জন। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের বৃহদায়তন বিনিয়োগ গ্রাহক ছিল ১৯৫৯ জন, এক্সিম ব্যাংকে ছিল ৬৭১ জন এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে ছিল ২৯৬ জন।
এ চিত্র থেকে দেখা যায়, ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের বিনিয়োগ কার্যক্রম মুষ্টিমেয় সংখ্যক মানুষের মধ্যে সীমিত না করে ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য অনুযায়ী তা সাধারণ জনগণের মাঝে সম্প্রসারিত করার নীতি অনুসরণ করেছে।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
ইসলামী ব্যাংকসমূহের মোট বিনিয়োগের খাতওয়ারী বণ্টন থেকেও জাতীয় উন্নয়নে তার নীতি ও কৌশল স্পষ্ট হবে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ ২০০৯ সালে শিল্পখাতে ৫৪%, বাণিজ্যিক (ক্রয়-বিক্রয়) খাতে ৩৩%, কৃষি ও সার খাতে ৭%, নির্মাণ ও আবাসন খাতে (Construction & Real Estate ) ৭%, পরিবহণ খাতে ২% এবং পল্লী উন্নয়ন, ক্ষুদ্র শিল্প, ডাক্তার প্রকল্প, কনজুমার প্রকল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসা, পোল্ট্রি ও ডেইরি প্রভৃতি খাতে ৬% বিনিয়োগ করেছে।
এর মাধ্যমে দেশে সরাসরি ১০ লাখের অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃত উপকারভোগীর সংখ্যা তারচে’ অনেক বেশি। আরো কয়েকটি ইসলামী ব্যাংকের ২০০৯ সালে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ পৃথকভাবে উপস্থাপন করা হলো :
ব্যাংকের নাম ও বিনিয়োগের পরিমাণ (মিলিয়ন টাকায়)(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
বিনিয়োগের খাত- | আল-আরাফাহ্ | সোস্যাল | শাহ্জালাল | এক্সিম | ফার্স্ট সিকিউরিটি |
শিল্প | ১৩৮৮৪ | ৪২২০ | ৫৭১৯ | ১৮৮০৩ | ১৪৫২ |
বাণিজ্য (আমদানি রপ্তানি ও ক্রয় বিক্রয়সহ) |
১৩৪২৫ | ১১৯৮৫ | ১১০১৫ | ৩১১১৫ | ২২৪৬৯ |
কৃষি, মৎস্য ও বনায়ন | ৫৮৮ | ৫ ১৮ | ৩৯৯ | ১২০৬ | ২২৪ |
নির্মাণ | ১৮১৩ | ১৩৬৪ | ৫২৩৯ | ৫৪২১ | ১৯৮৯ |
পরিবহন ও যোগাযোগ | ১২৩৬ | ৫১৭ | ২০৬২ | ১৬৮ ১ | ৭৯ |
দারিদ্র্য বিমোচন | ১৬ | ৩০৫ | ২০৮ | – | ৬৭০ |
বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ | ২১০ | ৭৯ | ৭৬৫ | – | – |
সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে ইসলামী ব্যাংকের ভূমিকা
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সামষ্টিক অর্থনীতির (macro economy) স্থিতিশীলতা, যার পূর্বশর্ত হলো মুদ্রাস্ফীতির নিম্নহার, সন্তোষজনক অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ, জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার বাঞ্ছিত পরিমাণ রিজার্ভ।
এসব শর্ত পূরণে সঞ্চালক শক্তিরূপে ব্যাংকিং সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। সুদী ব্যাংক সুদের ভিত্তিতে সঞ্চয় সংগ্রহ ও তা বিনিয়োগে শুধু সুদের পরিমাণকেই বিবেচনা করে।
এই কার্যক্রমের আর্থ-সামাজিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া তাদের বিবেচ্য নয়। উৎপাদন ও তার উপকরণের সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্কহীন সুদভিত্তিক কারবারের ফলে অনেক ক্ষেত্রে দ্রব্যের উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি ছাড়াই ঋণগ্রহীতাদের ঋণের সুদ এবং জমাকারী ও ব্যাংকের আয় বৃদ্ধি পায়।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
এভাবে কৃত্রিম উপায়ে বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে যায় এবং উৎপাদন কম হলে তার ওপর সুদের বাড়তি মূল্যও যোগ হয়। এ দুষ্টচক্রের ফলে অবাঞ্ছিত মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়। এভাবে নির্দিষ্ট আয়ের লোকদের ক্রয়ক্ষমতা এবং শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কমে যায়।
এ প্রক্রিয়ায় আর্থিকভাবে দুর্বল বিপুল মানুষের সম্পদ অধিক আর্থিক ক্ষমতাসম্পন্ন মুষ্টিমেয় লোকের হাতে পুঞ্জীভূত হয়। সুদী কারবারের মধ্য দিয়ে এই নীরব সম্পদ হস্তান্তর (Silent resource transfer) ঘটার ফলে অর্থের বণ্টন প্রবাহ ও সম্পদের মালিকানার ভারসাম্য নষ্ট হয়।
কার্ল মার্কস এ প্রক্রিয়াকেই ‘সিঁদেল চুরি’ বলে গাল-মন্দ করেছেন। সুদী ব্যাংকের মুনাফা বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে দেশে মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও ধনী-গরীবের পার্থক্য বৃদ্ধি পায়।
সুদের এমনি অসংখ্য কুফল থেকে সমাজকে রক্ষা করার জন্যই ইসলাম সুদকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। সুদমুক্ত ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতাও এখানেই নিহিত।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
ড. মুহাম্মদ বদিউল আলম ও মুহাম্মদ আবু মিসির বাংলাদেশের প্রচলিত ধারার ব্যাংকের সাথে সুদমুক্ত ব্যাংকের লাভ, উৎপাদন ক্ষমতা ও জাতীয় অর্থনীতিতে এর অবদান মূল্যায়ন করে তাদের একটি গবেষণাপত্রে উপসংহার টেনেছেন এভাবে :
Therefore it is clear that the interest-free banking system provides better service to the customers and contribute to the economy as a whole with high esteem of moral values then that of traditional banking system operating in our country.
দারিদ্র্য বিমোচন ও পল্লী উন্নয়ন
সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণা থেকে এখন এটা স্পষ্ট যে, জ্বালানি, শিল্প কিংবা কৃষিখাতের চাইতেও দরিদ্র জনগণের মাঝে বিনিয়োগ করে বেশি আর্থ- সামাজিক রিটার্ন পাওয়া সম্ভব।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতের বিনিয়োগ থেকেই সর্বোচ্চ আয় নিশ্চিত হয়। কার্যকর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ ও অনুপ্রাণিত জনগোষ্ঠী একটি অত্যাবশ্যকীয় পূর্বশর্ত।
এর ফলে আর্থ-সামাজিক কর্মক্ষেত্রে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়, সামাজিক অসাম্য দূর হয় এবং উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত হয়।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ দেশের প্রথম ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার বিনিয়োগ কার্যক্রম এই লক্ষ্যেই পরিচালিত করছে এবং বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এ ব্যাংক দেশের বৃহৎ কর্পোরেট গ্রাহকদেরকে এককভাবে বৃহত্তম বিনিয়োগ সুবিধা প্রদানের সামর্থ্য (Single party exposure) নিয়ে দেশের শিল্প-বিকাশে বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছে।
অন্যদিকে বিনা জামানতে ৫ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত পল্লীর হত-দরিদ্র ও সংকটপ্রবণ জনগোষ্ঠীর লোকদেরকে বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান করে তাদেরকে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করেছে।
ইসলামী ব্যাংক এভাবেই আয়ের (সম্পদ) পুনর্বণ্টন ও সুযোগের পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের প্রকৃত ক্ষমতায়ন, ধনী-গরিব বৈষম্য দূরীকরণ, সামাজিক সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ভূমিকা পালন করছে।
২০০০ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের মিলেনিয়াম শীর্ষ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে ২০১৫ সালের মধ্যে জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ দারিদ্র্য নিরসণের একটি কৌশলপত্র (PRSP) তৈরি করেছে।
এই কৌশলপত্র অনুযায়ী ২০০০-১৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর দারিদ্র্য ৩.৩ ভাগ হারে কমাতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৭.০০ ভাগে উন্নীত করতে হবে। ইসলামী ব্যাংকসমূহ জাতীয় উন্নয়নের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে চলেছে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড গ্রামীণ অর্থনীতিকে পুনরায় সক্রিয় করে তুলতে বিনা জামানতে ক্ষুদ্র ও ছোট বিনিয়োগের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প চালু করেছে।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
১৯৯৫ থেকে ২০০৯ সালের মার্চ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক এ প্রকল্পের আওতায় ১০৭৫১টি গ্রামে ৫,৭৭,৭৪০ জন গ্রাহকের মাঝে ২৪২৪.০০ কোটি টাকা বিতরণ করেছে।
২০০৯ সালের মার্চ পর্যন্ত এ প্রকল্পের উপকারভোগীর সংখ্যা ছিল ৪,৯২,৪৭৫ জন। তাদের শতকরা ৮৬ ভাগের বেশি হচ্ছেন মহিলা। এর ফলে গ্রামীণ জনপদে একটি অত্যন্ত ইতিবাচক গুণগত পরিবর্তন আসছে।
গ্রামের বিত্তহীন সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগ সুবিধা প্রদানের সাথে সাথে তাদেরকে অক্ষরজ্ঞান দেয়া হচ্ছে এবং নৈতিক ও মানবিক বোধে উদ্বুদ্ধ ও স্বাবলম্বী হবার প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। ফলে এই উপকারভোগীগণ পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যথাযথ মর্যাদা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সামর্থ্য অর্জন করছেন।
গ্রামীণ মহিলাদেরকে আয়ের সুযোগ সৃষ্টিকারী উৎপাদনমূলক কর্মকান্ডে যুক্ত করে তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও সামর্থ্যের বিকাশ ঘটানোর মধ্য দিয়ে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে মানব সম্পদ উন্নয়ন তথা সামাজিক উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করে ইসলামী ব্যাংক তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করছে।
প্রথমে ৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ নিয়ে নিজেদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে এ প্রকল্পের সদস্যদের কেউ কেউ এখন ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ নেয়ার সামর্থ্য অর্জন করেছেন । এটি একটি আর্থ-সামাজিক উত্তরণ প্রক্রিয়া।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ-এর অঙ্গসংস্থা ‘ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন’ পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য বিনামূল্যে টিউবওয়েল সরবরাহ করছে। গ্রামীণ স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং জনগণের স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সেনিটারি ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
ইসলামী ব্যাংকের পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় দেশকে সবুজায়ন করতে গত তিন বছরে মোট ১২,৭৫,০০০টি বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছে। একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এ জাতীয় সামাজিক কর্মসূচী ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে
নবতর সংযোজন।
এই ব্যাংকের বিভিন্ন বাণিজ্যিক অর্থায়নের মুনাফার হার ২০০৯ সালে যেখানে ছিল প্রায় ১৩ ভাগ, সেখানে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বিনিয়োগ গ্রাহক থেকে মুনাফা নেয়া হয় ১০ ভাগেরও কম হারে।
এই নিম্নহারে অর্থায়ন দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলামী ব্যাংকের আন্তরিক ও দৃঢ় প্রতিশ্রুতির বাস্তব বহিঃপ্রকাশ । এই ধরনের উদ্যোগ সম্পদের বণ্টন উৎসাহিত করছে এবং সমাজব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
শিল্পবিকাশে ইসলামী ব্যাংকসমূহের অবদান
বাংলাদেশের জিডিপিতে ২০০৯-১০ অর্থ বছরে শিল্পখাতের অবদান ছিল ২৮.৪ শতাংশ। শিল্পখাতে ইসলামী ব্যাংকসমূহের বিনিয়োগ অত্যন্ত সন্তোষজনক । বাংলাদেশের সকল ইসলামী ব্যাংক প্রকৃতিগতভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংক।
তবু তারা দীর্ঘমেয়াদী জমা সংগ্রহ করে। ইসলামী ব্যাংকসমূহ ৩১.১২.২০০৯ তারিখ পর্যন্ত তাদের মোট বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের ৬৫ শতাংশ শিল্পখাতে বিনিয়োগ করেছে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ পল্লীর দরিদ্রদের মাঝে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ কৰ্মসূচী বাস্তবায়নের পাশাপাশি দেশের শিল্পবিকাশে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করছে।
এ ব্যাংক তার জন্মলগ্ন থেকেই রফতানিমুখী পোশাক শিল্পে বিনিয়োগ করে দেশের রফতানি আয় বৃদ্ধি এবং বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানে পথিকৃতের ভূমিকা রেখেছে। এ শিল্পের পথ ধরে দেশে নানা ধরনের ফরোয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের বিকাশ ঘটেছে।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়নসহ দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এ শিল্প পালন করছে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। রফতানিমুখী পোশাক শিল্পে বিনিয়োগে ইসলামী ব্যাংক এখনো শীর্ষস্থানে রয়েছে।
শিল্পখাতে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগের পরিমাণ ২০০৯ সালে তার মোট বিনিয়োগের ৫৪ শতাংশেরও বেশি ছিল। তার মধ্যে রফতানিমুখী পোশাক ও বস্ত্রশিল্পে ব্যাংক তার মোট বিনিয়োগের ২৪% নিয়োজিত করেছে।
ইসলামী ব্যাংক অনেক বৃহৎ শিল্প গ্রুপকে এককভাবে প্রকল্প বিনিয়োগ ও চলতি মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ প্রদান করেছে। ২০০৯ সাল নাগাদ ব্যাংকের মোট শিল্প- প্রকল্পের সংখ্যা ছিল ১১৫০।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
এর মধ্যে ২২৬টি গার্মেন্টস, ১৯৪টি টেক্সটাইল, ১৬০টি কৃষিভিত্তিক, ৩২টি স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ২৭টি ঔষধ ও রসায়ন, ৩০টি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, ২৭টি ফিলিং স্টেশন, ১৩টি কোল্ড স্টোরেজ, ৬২টি রাইস মিল, ৩টি ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, ৬টি সিমেন্ট, ১৯টি ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড প্লাস্টিক, ৬টি জুট অ্যান্ড কেমিক্যাল, ৮টি সল্ট এবং বাকি ৩৮৬টি অন্যান্য শিল্প।
বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংকের শিল্পখাতে বিনিয়োগের চিত্র নিম্নে আলাদাভাবে উপস্থাপন করা হলো :
ইসলামী ব্যাংকসমূহের শিল্পখাতে বিনিয়োগসংখ্যা (২০০৯ পর্যন্ত)
ব্যাংকের নাম | বৃহৎ ও মাঝারি | ক্ষুদ্র | বিনিয়োগের পরিমাণ (মিলিয়ন টাকায়) |
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ | ১৫০০ | ২৫১৫ | ২৪৩৭৮০ |
আল আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক | ৪১২ | ১২৫৬ | ১৩৮৮৪ |
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক | ২৫৭ | ১৮১৩ | ১৯৯৬৫ |
শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক | ১৯৫ | ৫৯ | ১৮৬৪১ |
এক্সিম ব্যাংক | ৩৯৯ | ২৯৭ | ৩০৯৫৬ |
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক | ৩৫ | ১০ | ১৪৫২ |
২৭৯৮ | ৫৯৫০ | ৩২৮৬৭৮ |
ইসলামী ব্যাংক ২০০৯ সাল নাগাদ ৮০,০০০ গ্রাহককে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রকল্পে (Small and Medium Enterprises – SME) বিনিয়োগ প্রদান করেছে। বিভিন্ন ধরনের মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে।
দেশে শিল্পের ব্যাপক ভিত্তি গড়ে তোলা, দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাদের দ্বারা ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তোলা এবং ব্যাংকের বিনিয়োগ খাতকে বহুমুখীকরণের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র শিল্প বিনিয়োগ প্রকল্প চালু করা হয়েছে।
এই বিনিয়োগ প্রকল্পের আওতায় খাদ্য ও কৃষিনির্ভর শিল্প, প্লাস্টিক ও রাবার শিল্প, বনজ ও আসবাবপত্র শিল্প, প্রকৌশল শিল্প, চামড়া শিল্প, রাসায়নিক শিল্প, পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, সেবা শিল্প, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি শিল্প, কম্পিউটার প্রযুক্তি, কাগজ উৎপাদন শিল্প, হস্তশিল্প, মৎস্য ও পশু পালন খামার, ছিদ্রযুক্ত ইট, ছাদের টাইলস এবং ব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্য যেকোনো ক্ষুদ্রশিল্পে বিনিয়োগ সুবিধা দেয়া হয়।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) খাতে ব্যাংকের এযাবৎ প্রদত্ত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩৩২ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে ব্যাংকের সহায়তায় এসএমই খাতের কোন কোন উদ্যোক্তা বৃহৎ শিল্প গোষ্ঠীতেও উন্নীত হয়েছেন।
একটি ত্রিমুখী উন্নয়ন ধারার ব্যাংক হিসেবে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক নন- ফরমাল সেক্টরের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী এসএমই খাতে সার্ভিস ট্রেডিং এবং ম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠানকে স্বল্পমেয়াদে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা এবং মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে ২ থেকে ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান করে আসছে।
এছাড়া এসএমই খাতে ফরমাল সেক্টরের আওতায় সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান করছে। ব্যাংকের এসএমই খাতে ২০০৫ পর্যন্ত ৬৮৩ জন গ্রাহককে ৮০,৪৭,১১,২৬৯.০০ টাকা বিনিয়োগ প্রদান করা হয় ৷(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
সীমিত আয়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ইসলামী ব্যাংক
অগ্রাধিকার খাতসমূহে ও অনুন্নত এলাকায় বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সমাজের অপেক্ষাকৃত সুবিধা-বঞ্চিত মানুষের অবস্থার উন্নয়ন ও ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন সাধন এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বেগবান করার লক্ষ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ বিভিন্ন বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
তার মধ্যে রয়েছে পরিবহন বিনিয়োগ প্রকল্প, গৃহায়ণ বিনিয়োগ প্রকল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসা বিনিয়োগ প্রকল্প, গৃহসামগ্রী বিনিয়োগ প্রকল্প, কৃষি-সরঞ্জাম বিনিয়োগ প্রকল্প, ডাক্তার বিনিয়োগ প্রকল্প, মীরপুর রেশম তাঁতী বিনিয়োগ প্রকল্প প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
সীমিত আয়ের লোকদের আবাসন চাহিদা পূরণের জন্য গৃহায়ণ বিনিয়োগ প্রকল্পের অধীনে ইসলামী ব্যাংক রাজধানী এবং বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে বহুতল বাড়ি নির্মাণ ও ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য দেশে এবং বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশী হাজার হাজার গ্রাহককে বিনিয়োগ দিয়েছে।
ব্যাংক বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানিকেও বিনিয়োগ সুবিধা দেয়। এ প্রকল্পে ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ব্যাংকের মোট বিনিয়োগের শতকরা ৪ ভাগ।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
দেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা এবং শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ইসলামী ব্যাংক পরিবহন, যানবাহন ও গাড়ি বিনিয়োগ কর্মসূচী নিয়েছে।
পরিবহন বিনিয়োগ প্রকল্পের আওতায় বাস, মিনিবাস, ট্রাক, লঞ্চ, কার্গো ভেসেল, রেন্ট-এ কার সার্ভিসের জন্য গাড়ি ক্রয়ে সুবিধা দেয়া হয় ।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
এছাড়া ব্যাংক আৱ-কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বেবীটেক্সি, টেম্পো ও পিকআপ-ভ্যান, ক্লিনিক ও হাসপাতালের জন্য অ্যাম্বুলেন্স এবং বিভিন্ন পেশাজীবীর জন্য গাড়ি বিনিয়োগ কর্মসূচী চালু করেছে।
গ্রাম ও শহরের শিক্ষিত ও বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থান এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের সহযোগিতার উদ্দেশ্যে ইসলামী ব্যাংক ক্ষুদ্র ব্যবসা বিনিয়োগ কর্মসূচীর আওতায় প্রায় ২শ’ প্রকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ সুবিধা দিচ্ছে।
এর মধ্যে রয়েছে পশু পালন, মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, এগ্রোফার্মিং, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও উৎপাদন, ব্যবসা, দোকানদারী, পরিবহন, কৃষি উপকরণ, বনায়ন, লন্ড্রি, সাইনবোর্ড লেখা ইত্যাদি।এই খাতে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সুবিধাভোগী গ্রাহকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮ হাজার এবং বিনিয়োজিত অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৩৩ কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংকের কৃষি সরঞ্জাম বিনিয়োগ কর্মসূচীর আওতায় গ্রামীণ বেকার যুবকদের আৱ-কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সহজ শর্তে পাওয়ার টিলার, পাওয়ার পাম্প, শ্যালো টিউবওয়েল, মাড়াই কল ইত্যাদি সরবরাহ করা হয়। কৃষি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তাদানও এই প্রকল্পের লক্ষ্য।
নির্দিষ্ট আয়ের সরকারী, আধা সরকারী ও বেসরকারী চাকরিজীবীদের জন্য ইসলামী ব্যাংক দেশে প্রথম গৃহসামগ্রী বিনিয়োগ প্রকল্প চালু করে।
২০০৬ সাল পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক এ প্রকল্পের অধীনে প্রায় ১,৯০,০০০ জন স্বল্পআয়ের চাকরিজীবী মানুষকে ৫৭৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ দিয়েছে।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
সীমিত আয়ের লোকদেরকে সৎভাবে জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করার লক্ষ্যে পরিচালিত ইসলামী ব্যাংকের এই প্রকল্প অনেক প্রতিষ্ঠানকেই এ ধরনের প্রকল্প চালু করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
ইসলামী ব্যাংকের সামাজিক বিনিয়োগ
ভিন্নমুখী ব্যাংকিং লেনদেনের পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড জন্মলগ্ন থেকেই গরীব, দুঃস্থ, অসহায় ও নিঃসম্বল মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যুব কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন, দুঃস্থ পুনর্বাসন, পরিবেশ সংরক্ষণসহ সামাজিক খাতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
এসব কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে সেলাই প্রশিক্ষণ প্রকল্প, দুধেল গাভী পালন প্রকল্প, রিকশা ও ভ্যান গাড়ি প্রকল্প, পোল্ট্রি প্রকল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রকল্প, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মী প্রকল্প, ক্ষুদ্র শিল্প প্রকল্পসহ বিভিন্ন আয়-বর্ধক ও আত্ম-কর্মসংস্থানমূলক কর্মসূচী।
মডেল ফোরকানিয়া মক্তব, দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বৃত্তি ও অনুদান এবং দুঃস্থদের জন্য স্কুল পরিচালনা ও সাহায্য দানসহ শিক্ষা কর্মসূচী।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
মেডিক্যাল সেন্টার প্রতিষ্ঠা, দাতব্য চিকিৎসালয়ের জন্য অনুদান, নলকূপ স্থাপন, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মাণসহ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা কর্মসূচী। এতিমখানা প্রতিষ্ঠা, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে কন্যা পাত্রস্থ করার জন্য অনুদান, ঋণগ্রস্ত ও ভ্রমণপথে বিপদগ্রস্ত লোকদের অনুদানসহ মানবিক সাহায্য কর্মসূচী এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচী।
ইসলামী ব্যাংক মানব সম্পদ উন্নয়নের অংশ হিসেবে ক্ষুদে উদ্যোক্তা উন্নয়নসহ মানবকল্যাণে বিভিন্নমুখী সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, যেমন- হাসপাতাল, কম্যুনিটি হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ, ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার, প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং দুঃস্থ মহিলা পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিচালনা করছে।
সীমিত আয়ের লোকদের স্বাস্থ্য সেবার জন্য ইসলামী ব্যাংক সারাদেশে ৫টি হাসপাতাল ও ৪টি কম্যুনিটি হাসপাতালের মাধ্যমে ন্যূনতম খরচে প্রতিবছর ৪ লক্ষাধিক রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে।
এই খাতে ব্যাংক ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এছাড়া নিরাপদ পানির জন্য হস্তচালিত নলকূপ ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা স্থাপনে প্রায় পৌনে ২ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ১টি মেডিক্যাল কলেজ, ১টি নার্সিং ইনস্টিটিউট, ৫টি ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট এবং ১টি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল পরিচালনা করছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ৬৩০৮ জন শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণ করেছে।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি কর্মসূচীর অধীনে ৪,৩৯৭ জন ছাত্র-ছাত্রীকে বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে এবং ৮০৬ জন ছাত্রকে নিয়মিত বৃত্তি দেয়া হচ্ছে ৷ ছাত্র বৃত্তি খাতে ৩.৫৫ কোটি টাকাসহ শিক্ষাখাতে উক্ত সময় পর্যন্ত ব্যাংক সাড়ে ১০ কোটি টাকার বেশি অর্থ ব্যয় করেছে।
ব্যাংকের উদ্যোগে ঢাকায় স্থাপিত একটি দুঃস্থ মহিলা পুনর্বাসন কেন্দ্রের মাধ্যমে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিধবা, তালাকপ্রাপ্তা, পরিত্যাক্তা বা অভিভাবকহীন ১৮৭ জন মহিলাকে পুনর্বাসনের জন্য ৭৯ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
সমাজের দুঃস্থ, অসহায়, দরিদ্র লোকদের এককালীন সাহায্য বাবদ সারাদেশে ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ৪.৮২ কোটি টাকা।
এছাড়া বন্যা, খরা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ইসলামী ব্যাংক বরাবরই জরুরি সাহায্য নিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ খাতে ব্যাংক ২০০৫ সাল পর্যন্ত পৌনে ৯ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।
সলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ-এর এ সকল সামাজিক বিনিয়োগমূলক ও জনকল্যাণধর্মী কার্যক্রম দেশের ব্যাংকিং ক্ষেত্রে নতুন আদর্শ সৃষ্টি করেছে।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
ইসলামী ব্যাংকিং-এর আর্থিক দক্ষতা ও সামর্থ্য মূল্যায়ন
ক্রেডিট রেটিং ইনফরমেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (CRISL) নামক বহুজাতিক রেটিং সংস্থার ২০০২ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী রেটিংয়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ-এর অবস্থান ছিল ‘এ প্লাস’ (A+) যা ব্যাংকের সার্বিক আর্থিক সামর্থ্য ও মজবুত ভিত্তি নির্দেশ করে।
২০০৫ সালে CRISL ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান আরো উন্নীত করে ‘ডবল এ মাইনাস’ (AA-) এবং ২০০৯ সালে ‘ডবল এ প্লাস’ (AA+) নির্ধারণ করেছে যা ব্যাংকের উচ্চতর আর্থিক সামর্থ্য, অধিক নিরাপত্তা, অধিক ক্রেডিট মান ও সুদৃঢ় ক্রেডিট প্রোফাইলসম্পন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সত্তার নির্দেশক।
নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গ্লোবাল ফিন্যান্স ‘বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ব্যাংক পুরষ্কার’ (World’s Best Bank Awards)-এর আওতায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-কে তার কার্যক্রম ও কৃতিত্বের জন্য ১৯৯৯, ২০০০, ২০০৪ ও ২০০৫ সালে ‘বেস্ট ব্যাংক ইন বাংলাদেশ’ এবং ২০০৮ সালে ‘বেস্ট ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিডিশন’ পুরস্কারে ভূষিত করেছে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সদস্যরূপে ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রসারের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বাহরাইনভিত্তিক অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড অভিটিং অর্গানাইজেশন ফর ইসলামিক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস (AAOIFI), জেনারেল কাউন্সিল ফর ইসলামিক ব্যাংকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফিন্যান্সিয়াল মার্কেট (IIFM), সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক কনসিলিয়েশন অ্যান্ড কমার্শিয়াল আরবিট্রেশন সেন্টার, মালয়েশিয়াভিত্তিক ইসলামিক ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বোর্ড (IFSB) ও ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (বাংলাদেশ চ্যাপ্টার) ইত্যাদি।
জাতীয় পর্যায়ে ইসলামী ব্যাংকসমূহ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম), দি ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (আইবিবি), বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংকস ( BAB), বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স এসোসিয়েশন (BAFEDA), ইসলামী ব্যাংকসমূহের কেন্দ্রীয় শরীয়াহ বোর্ড (CSBIB), ইসলামিক ব্যাংকস কনসালটেটিভ ফোরাম (IBCF), ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের সদস্য।
দেশের বেসরকারী খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে জমা, বিনিয়োগ, পরিচালনাগত মুনাফা, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য, রেমিট্যান্স সংগ্রহ প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় অবস্থান অর্জনের পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দু’হাজার এবং এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় পাঁচশ’ ব্যাংকের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
উন্নত মানের ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি মূলধনের পর্যাপ্ততা, পরিসম্পদের গুণাবলী, মুনাফা অর্জন ও যথার্থ তারল্য পরিস্থিতি প্রভৃতি মিলিয়ে ইসলামী ব্যাংক একটি সফল ব্যাংকের দৃষ্টান্ত বলে বিবেচিত হচ্ছে।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
একবিংশ শতকের বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং
ইসলামী ব্যাংক সকল বিচারে একটি গণ-ব্যাংক ও সার্বজনীন ব্যাংক হিসেবে ইসলামী অর্থনীতির আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য অনুসরণ করে দেশের ভারসাম্যপূর্ণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করছে।
ইসলামী আদর্শের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সৌন্দর্য, ব্যাংকের সকল স্তরের জনশক্তির সৎ, আন্তরিক ও আত্মনিবেদিত সেবা, প্রতিষ্ঠানের সকল পর্যায়ে দুর্নীতিমুক্ত কার্যক্রম, ব্যাংকার ও গ্রাহকের মধ্যকার ভ্রাতৃত্ব ও অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্ক এ ব্যাংকের সার্বিক পরিবেশকে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে।
কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারার প্রবর্তকরূপে ইসলামী ব্যাংক দেশের আর্থ-সামাজিক খাতে গত প্রায় তিন দশকে যে অবদান রেখেছে তার আলোকে বলা যায়, দেশের সার্বিক ব্যাংকব্যবস্থা ইসলামী অর্থনীতির আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য নিয়ে কাজ করলে দেশের ছয় সহস্রাধিক শাখার এ বিরাট ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের অভাবী মানুষের হতাশা মুছে ফেলতে এবং সামগ্রিকভাবে দেশকে সমৃদ্ধ করতে অসামান্য অবদান রাখতে পারে।
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইসলামী ব্যাংকের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে দেশের নেতৃস্থানীয় তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে ব্যাংকিং খাতের অনেক শীর্ষ ব্যক্তি মনে করেন, একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের গোটা ব্যাংকব্যবস্থা ইসলামী পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হবে। এর ফলে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নতুন গতি ও উদ্যম সৃষ্টি হবে।
সবশেষে বিখ্যাত পশ্চিমা সাময়িকী ‘ইকনোমিস্ট’-এর একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যায়। ১৯৯৪ সালের ৬ আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত ‘সার্ভে অব ইসলাম’ শিরোনামের একটি দীর্ঘ প্রতিবেদনে বলা হয় :
অতীতে বিশ্ববাসী মুসলিম স্পেন ও আন্দালুসিয়া থেকে আধুনিক শিক্ষা-সংস্কৃতি বিষয়ে জেনেছিল এবং ইসলামের কাছ থেকে ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিল। আর এখনকার বিশ্ব ইসলামের কাছ থেকে ইসলামী ব্যাংকিং-এর আইডিয়া গ্রহণ করতে পারে।
ইকনোমিস্ট-এর দৃষ্টিতে মুসলমানদের অতীত গৌরব তার শিক্ষাপদ্ধতি। আর দীর্ঘকাল পর মানবজাতির প্রতি ইসলামের বর্তমান উপহার ইসলামী ব্যাংকিং।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)
ইকনোমিস্ট-এর এ বক্তব্যের সারকথা হলো : ইসলামী ব্যাংকিং ইজ সুপিরিয়র টু কনভেনশনাল ওয়েস্টার্ন মডার্ন ব্যাংকিং সিস্টেম। পশ্চিমা আধুনিক ব্যাংকিং- এর সীমাবদ্ধতা অনেক আগেই অর্থনীতিবিদদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে।
তার মুকাবিলায় ইসলামী ব্যাংকিং একটি বিশেষ ধর্মীয় পদ্ধতি হিসেবে নয়, বরং সার্বজনীন আর্থিক ব্যবস্থা হিসেবে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মানুষের সামনে মুক্তির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। ইসলামী ব্যাংকিং হলো আর্থিক দুনিয়ায় এক অনন্য বিপ্লব।(বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং)