প্রিয় বন্ধুরা, আজকে আলোচনা করবো ইসলামী সভ্যতায় ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক চিন্তার আদ্যোপান্ত নিয়ে। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। এই আর্টিকেল আপনাকে ইসলামী সভ্যতায় ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক চিন্তা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবে।
আপনি জানেন ইসলামী ব্যাংকিং একটি জনপ্রিয় ব্যাংক ও অর্থ ব্যবস্থা। কিন্তু ইসলামি ব্যাংকিং নিয়ে ভালোভাবে না জানার কারনে প্রায়ই মানুষজন বিভিন্ন সমস্যায় পড়েন। তাহলে চলুন জেনে নিই- ইসলামী সভ্যতায় ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক চিন্তা সম্পর্কে;
প্রাচীনকালে ইসলামী সভ্যতায় ব্যাংকিং
প্রায় সাড়ে পাঁচহাজার বছর আগে খ্রিস্টপূর্ব ৩৪ শতাব্দীতে প্রাচীন ইরাকে সুমেরীয়রা তাদের উপাসনালয়গুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের ব্যাংকিং লেনদেন পরিচালনা করতেন। সে যুগে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য মোটামুটি সংগঠিত রূপলাভ করেছিল। ইসলামী সভ্যতায় ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক চিন্তার আদ্যোপান্ত জানতে এই পোস্ট পড়ুন।
ফলে বিনিময় মাধ্যমরূপে মুদ্রার প্রচলন হয়েছিল বেবিলনীয় সভ্যতায় ব্যাংকিং কার্যক্রম প্রচলিত ছিল। এ সম্পর্কে জানা যায় খ্রিস্টপূর্ব ২০ শতাব্দীর প্রাচীন দলিল থেকে।
খ্রিস্টপূর্ব ১৮ শতাব্দীতে ব্যাংকিং ব্যবসায়ের প্রথম আইন-বিধি রচিত হয় বলে গবেষকগণ মনে করেন। বেবিলনীয়রা তাদের উপাসনালয়গুলোকে অর্থকড়ি জমা রাখার সুরক্ষিত, নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য স্থান মনে করতেন ।
প্রাচীনকালে গ্রীকদের ব্যাংকিং কার্যক্রম বেবিলনীয়দের প্রায় অভিন্ন নিয়মে পরিচালিত হতো। তাদেরও ধর্মীয় উপাসনালয় গুলোই ছিল ব্যাংকিং লেনদেনের প্রধান কেন্দ্র। তবে সরকারী সংস্থা এবং বেসরকারী উদ্যোক্তাগণও জামানত গ্রহণ, ঋণ দান, চেক প্রদান, বিভিন্ন শহরের মধ্যে মুদ্রা বিনিময় ও স্থানান্তর প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত ছিলেন বলে জানা যায়।
রোমীয়রা তাদের ব্যাংকিং কার্যক্রমে গ্রীকদের অনুরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। রোম-সভ্যতার বিকাশ ও প্রভাবের ফলে তৎকালীন বিশ্বের বিস্তীর্ণ এলাকায় তাদের অনুন্নত ব্যাংকব্যবস্থার প্রসার ঘটে।
প্রাচীন আমলের ব্যাংকিং
খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে চীনে ‘শালী ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১০৫ খ্রিস্টাব্দে চীনে কাগজ আবিষ্কার ব্যাংকব্যবস্থার উন্নতিতে বিশেষ অবদান রাখে। প্রথম ও দ্বিতীয় ঈসায়ী শতাব্দীতে মিসরীয়রা ব্যাংকিং ব্যবসায়ে প্রভূত উন্নতি সাধন করে।
প্রাচীন আমলের ব্যাংকিং কারবারে সুদের আদান-প্রদান নিষিদ্ধ ছিল। খ্রিস্টান জগতে খ্রিস্ট ধর্মের শুরু থেকে সংস্কার আন্দোলনের অভ্যুদয় এবং রোমে পোপনিয়ন্ত্রিত চার্চ থেকে অন্যান্য চার্চের বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সুদ নিষিদ্ধ ছিল।
অষ্টম শতাব্দী থেকে শুরু করে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানদের নেতৃত্বে বিশ্বের তৎকালীন সবচে’ শক্তিশালী অর্থনীতি সুদ ছাড়াই পরিচালিত হয়েছে। (ইসলামী সভ্যতায় ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক চিন্তা)
রোম সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় এবং রাজনৈতিক পতনের সাথে সাথে ঈসায়ী পঞ্চম শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার সূচনা হয়।
এ অস্থিতিশীল বিশ্ব পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং ব্যবসায়ের আন্তর্জাতিক যোগসূত্র ছিন্ন হয়। রোমের পতনের পর থেকে ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়টি ইতিহাসের অন্ধকার যুগ। তৎকালীন বিশ্ব নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্নীতির পঙ্কিল আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল।
ইসলামী সভ্যতায় ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক চিন্তা
ইসলামের অভ্যুদয়ের ফলে অশান্ত বিশ্বে দ্রুত নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার পরিবেশ ফিরে আসে। এ পরিবেশ ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক লেনদেন ও ব্যাংকিং কার্যক্রম বিকাশের সহায়ক হয়। রাসূল (সা:)-এর আবির্ভাবকালে তৎকালীন মক্কায় অর্থ আমানত ও বিনিয়োগের তিনটি পদ্ধতির প্রচলন লক্ষ করা যায় (ইসলামী সভ্যতায় ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক চিন্তা):
১. বিশ্বস্ত লোকের কাছে আমানত রাখা;
২. অংশীদারীভিত্তিতে ব্যবসায়ে মূলধন বিনিয়োগ;
৩. সুদে টাকা লগ্নি করা;
মক্কায় বিশ্বস্ততম ব্যক্তিরূপে রাসূল (সা:) নবুওয়াত লাভের আগেই ‘আল- আমীন’ হিসেবে সম্মানিত ছিলেন। বহু লোক তাদের ধনসম্পদ তাঁর কাছে জমা রাখতেন।
মদীনায় হিজরত করার সময়ও রাসূল (সা:)-এর কাছে বহু লোকের অর্থসম্পদ গচ্ছিত ছিল। সেগুলো যথাযথ মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য রাসূল (সা:) হযরত আলী (রা)-কে দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
লোকদের অর্থকড়ি বিশ্বস্ততার সাথে সংরক্ষণ করা ছাড়াও রাসূল (স) নবুওয়াতের অনেক আগেই হযরত খাদিজা (রা)-এর সাথে ‘মুদারাবা’ পদ্ধতিতে অংশীদারী কারবারে নিয়োজিত হয়েছিলেন।
মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ইসলামের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিধিবিধানসমূহ প্রবর্তন করা হয় । জনগণের বিশ্বাসের সকল বিচ্যুতি সংশোধন, ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা এবং শোষণ বন্ধ করার লক্ষ্যে এ সময় সকল প্রকার সুদী কারবার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়। (ইসলামী সভ্যতায় ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক চিন্তা)
বায়তুল মাল
ইসলামের প্রথম অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাসূল (3)-এর সময় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বায়তুল মাল’। কাঠামোগতভাবে ‘বায়তুল মাল’ কোন মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান ছিল না। বরং একে রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা Exchange বলা যেতে পারে। প্ৰাচুৰ্যসম্পন্ন ব্যক্তিরা বায়তুল মালে সাহায্য পাঠাতেন এবং অভাবগ্রস্ত লোকদের মাঝে তা বণ্টন করা হতো।
সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে প্রচলিত ব্যবসা-বাণিজ্যে কিংবা জীবন ও সমাজে কোনরূপ বাধা বা জটিলতা সৃষ্টি হয়নি। বরং সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে ইসলামী সভ্যতা মানবজাতিকে প্রায় হাজার বছর ধরে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়।
কুরআন, সুন্নাহ্ এবং অনুসরণীয় ইমাম ও মনীষীদের ইজমা ও কিয়াসের মাধ্যমে প্রাপ্ত নীতিমালা মানবজাতির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুবিন্যস্তভাবে কল্যাণ ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে।
ইসলামের প্রাথমিক যুগের ব্যাংকিং লেনদেন
ইসলামের প্রাথমিক যুগের ব্যাংকিং লেনদেনের ক্ষেত্রে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা)-এর দৃষ্টান্ত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রাজ্ঞ এ সাহাবী তাঁর বিশ্বস্ততার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। বহু লোক তাদের অর্থকড়ি হেফাযত করার স্বার্থে তাঁর কাছে জমা রাখতে আসতেন। হযরত যুবাইর (রা) সেসব অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ না করে কর্জ হিসেবে নিতেন।
এর ফলে তিনি (১) সে অর্থ ব্যবহার করার অধিকার লাভ করতেন এবং (২) সে অর্থের মালিকের জন্যও তা অধিকতর নিরাপত্তার কারণ হতো। তখনকার দিনেই হযরত যুবাইর (রা)-এর কাছে বিভিন্ন লোকের বাইশ লাখ দিরহাম জমা হয়েছিল।
খুলাফা-ই-রাশেদীনের যুগে হযরত ইবনু ‘আব্বাস (রা) দিরহাম জমা গ্রহণ করে
খুলাফা-ই-রাশেদীনের যুগে হযরত ইবনু ‘আব্বাস (রা) দিরহাম জমা গ্রহণ করে কুফায় তা ভাঙানোর স্বীকারপত্র লিখে দিতেন। একইভাবে হযরত যুবাইর (রা)-এর পুত্র আবদুল্লাহ মক্কায় দিরহাম জমা গ্রহণ করে ইরাকে তা ভাঙানোর স্বীকারপত্র লিখে দিতেন।
আবদুল্লাহর ভাই মুস’আব ইরাকে সে স্বীকারপত্র ভাঙিয়ে নগদ অর্থ প্রদান করতেন। উমাইয়া শাসনামলে মুসলমানদের ব্যাংকিং লেনদেনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি হয়। এ ক্ষেত্রে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সময়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে আলেপ্পোর আমীর সাইফ-আদ-দৌলাহ হামাদান-এর সময় হুণ্ডির ভিত্তিতে লেনদেনের ব্যাপক প্রচলনের তথ্য জানা যায়।
হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর সূচনালগ্নে ১০১০ খ্রিস্টাব্দে বসরায় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হুণ্ডির লেনদেন এবং মুদ্রা বিনিময় ব্যবসায়ের ব্যাপক প্রসার ঘটে। খ্রিস্টীয় এগারো শতাব্দীর মধ্যভাগে পারস্য দেশীয় পর্যটক নাসের খসরু বসরায় ব্যাংকিং লেনদেনের ব্যাপক প্রচলনের কথা তাঁর সফরনামায় উল্লেখ করেছেন।
ইসলামী সভ্যতার বিকাশের শুরু থেকে প্রায় হাজার বছরব্যাপী ইসলামের সুপ্রতিষ্ঠিত প্রভাবকালে অর্থনৈতিক চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে মুসলমানদের নেতৃত্ব অব্যাহত ছিলো।
পরবর্তী: ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী
প্রিয় পাঠক, iBankHub এর এই ছিল ইসলামী সভ্যতায় ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক চিন্তা বিষয়ক আয়োজন। আশা করছি এই বিষয়ে আপনার কিছুটা ধারনা হয়েছে। আপনি চাইলে ইসলামি ব্যাংকিং সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পারেন। নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজটি লাইক ও ফলো করে রাখুন। (ইসলামী সভ্যতায় ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক চিন্তা)