ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি

বিনিয়োগ নীতি

ইসলামী ব্যাংক ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য বাস্তবায়নের একটি মাধ্যম বিধায় ইসলামী অর্থনীতির মৌলিক লক্ষ্যসমূহ সামনে রেখে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি । সে অনুযায়ী :

১. ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ পদ্ধতি ইসলামী শরীয়ার দৃষ্টিতে হালাল হতে হবে। সেইসাথে বিনিয়োগের খাতও হালাল হতে হবে।

Advertisement

২. ইসলামী ব্যাংক বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি সামাজিক কল্যাণের দিকেও নজর রাখবে।

৩. বিনিয়োগের খাত এমনভাবে নির্ধারিত হতে হবে যাতে সমাজের মৌলিক চাহিদাগুলো ইসলামী নীতির ক্রম-অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পূরণ হতে পারে।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

৪. ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদ উৎপাদন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, সে সম্পদ বণ্টনের গুরুত্ব তারচে কম নয়। সম্পদ বণ্টনের ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ কার্যক্রমকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করবে।

Advertisement

ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ নীতির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো হলো :

১. মূলধনের নিরাপত্তা ও মুনাফার সম্ভাব্যতা বিবেচনায় রেখে ব্যাংকের বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা।

Advertisement

২. বিনিয়োগের অন্যতম লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এজন্য প্রয়োজনীয় মূলধন ও দক্ষতার সমন্বয় ঘটানো। বৈজ্ঞানিক, কারিগরি, প্রযুক্তিগত ও পেশাগত সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা।

৩. পুঁজির মালিক যাতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রকৃত ও বাস্তব ভূমিকা রেখে হালাল মুনাফা পেতে পারেন তার ব্যবস্থা করা। উন্নয়ন কার্যক্রমে গতি সঞ্চার করে সমাজকে কর্মচঞ্চল করে তোলার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করা।

৪. পারিপার্শ্বিকতা ও পরিবেশ এবং দেশের সামগ্রিক চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে বিনিয়োগ করা।

৫. সম্পদ মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত না করে তা সমাজের সিংহভাগ মানুষের কাজে লাগানোর ইসলামী নীতিকে অগ্রাধিকার দান।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

Advertisement

৬. উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদক ও উৎপাদনমুখী শিল্পের সংখ্যা বৃদ্ধি ও তাদের ভিত মজবুত করা।

৭. বিনিয়োগের মাধ্যমে অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন ও সামাজিক অবকাঠামো গঠনের উদ্যোগে অংশগ্রহণ।

৮. গ্রাহককে সরাসরি টাকা না দিয়ে মুরাবাহা, বাই মুয়াজ্জাল প্রভৃতি বেচাকেনা পদ্ধতিতে বিনিয়োগ। এই পদ্ধতির বিনিয়োগ প্রকৃত ব্যবসা- বাণিজ্যকে উৎসাহিত করে ও এগিয়ে নেয়।

৯. লাভ-লোকসানে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মুশারাকা ও মুদারাবা পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করা।

Advertisement

১০. ব্যাংকের সব ধরনের বিনিয়োগ কার্যক্রম ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী পরিচালনা । শরীয়ার দৃষ্টিতে অবৈধ ও সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক খাতে প্রচুর মুনাফা থাকলেও সে খাতে বিনিয়োগ না করা।

১১. সামাজিক কল্যাণমূলক খাতে মুনাফা কম হলেও সেসব খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

Table of Contents

বিনিয়োগ পদ্ধতি

ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থায় ইসলামী শরীয়াহভিত্তিক বিভিন্ন বিনিয়োগ পদ্ধতি রয়েছে। বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংক তাদের নিজ নিজ দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও বিনিয়োগের ধরন অনুযায়ী শরীয়তের সীমার মধ্যে নানা পদ্ধতি অনুসরণ করে।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো শরীয়াহ্ অনুমোদিত যেসব পদ্ধতি সাধারণ- ভাবে অনুসরণ করে সে পদ্ধতিগুলোকে প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় :

ক অংশীদারি পদ্ধতি:

১. মুদারাবা ও ২. মুশারাকা;

খ. মালিকানায় শরীকানা বা শিরকাতুল মিলক-এর ভিত্তিতে ভাড়ায় ক্রয় : হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিল্‌ল্ফ (HPSM)

গ. বেচা-কেনা পদ্ধতি :

১. বাই-মুরাবাহা, ২. বাই-মুয়াজ্জাল, ৩. বাই-সালাম এবং ৪. ইসতিসনা।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

ক. অংশীদারি পদ্ধতি

‘মুদারাবা’ পরিভাষাটি আরবী ‘দার(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)ব’ শব্দ হতে উদ্ভূত। এ শব্দের একটি অর্থ ভ্রমণ বা সফর করা। মুদারাবা বলতে বুঝায় ব্যবসার জন্য সফর করা।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

‘মুদারাবা’ কারবারে দু’টি পক্ষ থাকেন। একপক্ষ মূলধন সরবরাহ করেন। অন্যপক্ষ তার সময়, মেহনত, মেধা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কাজে লাগান। মূলধন সরবরাহকারীকে বলা হয় ‘সাহিবুল মাল’।

সময়, মেহনত, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা বিনিয়োগকারী হলেন ‘মুদারিব’। ‘মুদারাবা’ এক ধরনের অংশীদারি চুক্তি। ‘সাহিবুল মাল’ এ চুক্তি অনুযায়ী মুদারিবকে তার দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, মেহনত ও চেষ্টার মাধ্যমে ব্যবসা চালানোর জন্য পুঁজি সরবরাহ করেন ৷

ব্যবসায়ে লাভ হলে চুক্তিতে উল্লেখিত অনুপাত অনুসারে উভয়পক্ষ লাভের ভাগিদার হন। লোকসান হলে আর্থিক ক্ষতি তহবিল সরবরাহকারী অর্থাৎ ‘সাহিবুল মাল’ বহন করেন আর ‘মুদারিব’ লোকসানী কারবারে দেয়া সময়, মেহনত ও দক্ষতার বিনিময় বা ফায়দা থেকে বঞ্চিত হন।

তবে বিশ্বাসভঙ্গ, দুর্নীতি, অবহেলা বা চুক্তির শর্তলঙ্ঘনের কারণে ব্যবসায়ে ক্ষতি হলে মুদারিব সে আর্থিক লোকসানের জন্যও দায়ী হবেন।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

মুদারাবা’ চুক্তির শর্ত অনুসারে ব্যাংক মূলধন যোগায়। অন্যপক্ষ স্বনিয়োজিত উদ্যোক্তা তার দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, মেহনত, নিয়োজিত করেন। ব্যাংক ‘সাহিবুল মাল’ হিসেবে মূলধন যোগায়। মুদারিব’ সে পুঁজি ব্যবসায় খাটান।

চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ব্যাংক ও উদ্যোক্তার মধ্যে মুনাফা ভাগ হয়। ব্যবসায়ে অনিচ্ছাকৃত লোকসান হলে আর্থিক লোকসান সাহিবুল মাল’ হিসেবে ব্যাংক বহন করে।

মুদারাবা কারবারের মুনাফা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে কারবারের স্বাভাবিক উৎপাদন ও পরিচালন সংক্রান্ত যাবতীয় খরচ বিবেচনায় আনতে হবে।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

এছাড়া কারবারের কাজে মুদারিব নিজ শহরের বাইরে যাতায়াত ও অবস্থান করলে সফরকালে পানাহার, পোশাক, পরিবহন, যাতায়াত ও খিদমতের জন্য নিযুক্ত পরিচারকের খরচ পাবেন।

তবে নিজ শহরে অবস্থানকালে মুদারিব তার নিজের পানাহার, পোশাক-আশাকসহ নিজস্ব কোন খরচ কারবার থেকে নিতে পারবেন না। মুদারিবকে তার কাজের জন্য কোন বেতন-ভাতা দেয়াও বৈধ নয়।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (IDB) মুদারাবার সংজ্ঞায় বলেছে:

Mudaraba is a form of partnership where one party (Sahib al Maal/Rabbul Maal) provides the fund while the other provides the expertise and management(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি).

The latter is reffered to as the Mudarib (Manager). Any profit accrued is shared between the two parties on a pre-agreed basis, while capital loss is exclusively borne by the partner providing the capital (sahib al Maal).

অর্থাৎ মুদারাবা এক ধরনের অংশীদারিত্ব ধরনের অংশীদারিত্ব যেখানে একপক্ষ ( সাহিবুল মাল/রাব্বুল মাল) তহবিল সরবরাহ করেন এবং অন্যপক্ষ তার দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনা নিয়োজিত করেন। তাকে বলা হয় মুদারিব (ব্যবস্থাপক)।

ব্যবসায়ের লাভ দু’পক্ষের মধ্যে পূর্বনির্ধারিত অনুপাতে ভাগ হয়। পুঁজির লোকসান হলে তা মূলধন সরবরাহকারী (সাহিবুল মাল) বহন করেন।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

AAOIFI-এর মতে :

Mudaraba is a partnership in profit whereby one party provides capital (rab al maal) and the other party provides labour (mudarib).

অর্থাৎ মুদারাবা হলো মুনাফায় অংশীদারিত্ব, যেখানে এক পক্ষ (রাব্বুল মাল ) মূলধন যোগায় এবং অপর পক্ষ (মুদারিব) মেহনত করেন।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

ব্যাংক কোম্পানী (সংশোধন) আইন ১৯৯৫-এ মুদারাবার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে :

Mudaraba means such an agreement in terms of which a bank conducted in accordance with the Islami Shariah provides capital for anything and the customer employs his efficiency, efforts, labour and intelligence.

“মুদারাবা” অর্থ এমন চুক্তি যাহার শর্তানুসারে ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক পরিচালিত কোন ব্যাংক কোন কিছুতে মূলধন যোগান দেয় এবং গ্রাহক উহাতে দক্ষতা, প্রচেষ্টা, শ্রম ও প্রজ্ঞা নিয়োজিত করে।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

সেন্ট্রাল শরীয়াহ্ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস্ অব বাংলাদেশ কর্তৃক প্রণীত ও বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরিত ‘(প্রস্তাবিত) ইসলামী ব্যাংক কোম্পানি আইন’-এ মুদারাবার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে :

shar“মুদারাবা” (Mudaraba) বলিতে এমন এক ব্যবসায়িক দ্বিপাক্ষিক চুক্তিকে বুঝাইবে, যাহাতে একপক্ষ মূলধন যোগান দিবে আর অন্যপক্ষ তাহার দক্ষতা, শ্রম ও প্রচেষ্টা কাজে লাগাইয়া ব্যবসায় পরিচালনা করিবে।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

মূলধন সরবরাহকারীকে সাহিব-আল- মাল ও ব্যবহারকারী(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)কে মুদারিব বলা হয়। প্রাপ্ত মুনাফা চুক্তিতে উল্লিখিত অনুপাতের ভিত্তিতে উভয় পক্ষের মধ্যে বণ্টিত হইবে ।

কোন ক্ষতি হইলে সাহিব-আল-মাল ক্ষতি বহন করিবে, তবে যদি সেই ক্ষতি মুদারিব কর্তৃক নিয়ম লঙ্ঘন, অবহেলা বা চুক্তিভঙ্গের কারণে হইয়া থাকে তাহা হইলে মুদারিবকে ক্ষতির দায়-দায়িত্ব বহন করিতে হইবে। সাহিব-আল-মাল মুদারাবা চুক্তির অধীনে পরিচালিত ব্যবসায়ের ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করিতে পারিবে না।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর মুদারাবা ম্যানুয়েলে মুদারাবা চুক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে :

Mudaraba is a partnership in profit whereby one party provides capital and the other party provides skill and labour. The provider of capital is called ‘Sahib-al-maal’ while the provider of skill and labour is called ‘Mudarib’.

অর্থাৎ মুদারাবা হলো মুনাফাভিত্তিক একটি অংশীদারিত্ব যেখানে এক পক্ষ মূলধন যোগান দেন এবং অন্য পক্ষ তার দক্ষতা ও মেহনত কাজে লাগান । পুঁজির যোগানদারকে বলা হয় ‘সাহিবুল মাল’। দক্ষতা মাল’। দক্ষতা ও মেহনত বিনিয়োগকারীকে বলা হয় ‘মুদারিব’।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

ব্যাংকিং বিনিয়োগে মুদারাবার বৈশিষ্ট্য

ব্যাংক ‘সাহিবুল মাল’ হিসেবে মূলধন যোগায় এবং স্বনিয়োজিত উদ্যোক্তা বা গ্রাহক ‘মুদারিব’ হিসেবে সে মূলধন ব্যবসায় খাটান।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

ব্যবসা পরিচালনা করেন গ্রাহক বা মুদারিব।

ব্যাংক ‘সাহিবুল মাল’ হিসেবে ব্যবস্থাপনায় অংশ নেয় না । তবে ব্যবসায়ের তদারকি এবং পরামর্শ ও উপদেশ দিতে পারে।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

ব্যবসায়ের লাভ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ব্যাংক ও উদ্যোক্তার মধ্যে ভাগ হয়।

চুক্তির শর্ত পালন নিশ্চিত করতে ব্যাংক গ্রাহকের কাছ থেকে পারফরমেন্স গ্যারান্টি নিতে পারে।

প্রকৃত লোকসানের দায়িত্ব সাহিবুল মাল হিসেবে ব্যাংক বহন করে।

দ্যোক্তা (মুদারিব) বা তাঁর কর্মচারী বা প্রতিনিধির শর্তলঙ্ঘন, অবহেলা, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, অব্যবস্থা বা বিশ্বাসভঙ্গের কারণে ব্যবসায়ে লোকসান হলে ব্যাংক উদ্যোক্তার কাছ থেকে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারে।

ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া উদ্যোক্তা অন্যকোন উৎস থেকে ব্যবসায়ের মূলধন নিতে পারেন না। নিলে তা উদ্যোক্তার ব্যক্তিগত ঋণ হিসেবে গণ্য হবে।

মুদারিব কারবার থেকে মুনাফার নির্ধারিত অংশের অতিরিক্ত কোন পারিশ্রমিক বা ভাতা কিংবা নিজস্ব কোন খরচ নিতে পারেন না। তবে কারবার পরিচালনার কাজে স্বাভাবিক ও অপরিহার্য খরচ নিতে পারেন।

চুক্তির মেয়াদ শেষে লাভ-লোকসান হিসাব চূড়ান্ত করে কারবার সমাপ্ত করতে হয়।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সম্মত সময়সূচী অনুসারে (যেমন-তিন মাস, ছয় মাস, এক বছর পর পর) প্রাক্কলিত লাভ-লোকসান বণ্টন করা যেতে পারে। তবে তা অগ্রিমরূপে গণ্য হয়। মেয়াদ শেষে চূড়ান্ত হিসেবের সাথে তা সমন্বয় করতে হবে।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

মুশারাকা

‘মুশারাকা’ পরিভাষাটি আরবী ‘শিরকাত’ বা ‘শরীকাত’ (শিক) শব্দ হতে উদ্ভূত। আরবীতে শিরকাত বা শরীকাত বলতে অংশীদারিত্ব বুঝায় । ইসলামী ব্যাংকিং পরিভাষায় ‘মুশারাকা’ এক বিশেষ অংশীদারী কারবার।

‘মুশারাকা’ হলো দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা সংস্থার মধ্যে এক ধরনের অংশীদারিত্বের চুক্তি। এতে সকল অংশীদার মূলধন গঠনে অংশ নেন । সকল অংশীদার বা তাদের কেউ কেউ ব্যবস্থাপনায় অংশ নিতে পারেন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মুনাফা বণ্টন হয়। লোকসান হলে অংশীদারগণ মূলধন বা ইক্যুইটির অনুপাতে তা বহন করেন।

‘মুশারাকা’ চুক্তির অধীনে ব্যাংক মূলধনের একটি অংশ যোগান দেয় । বাকি অংশ যোগান দেন গ্রাহক। ব্যবসায়ের মুনাফা বণ্টনের অনুপাত ব্যাংক ও গ্রাহকের মধ্যে চুক্তির ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। মুশারাকা কারবারে লোকসান হলে ব্যাংক ও গ্রাহক মূলধনের আনুপাতিক হারে তা বহন করেন।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

আধুনিককালে ফকীহদের একটি অংশের মতে, মুশারাকা ব্যবসায়ের ম্যানেজিং পার্টনার হিসেবে কেউ নিযুক্ত হলে তিনি কারবারের লাভ-লোকসানের ভাগী হবার পাশাপাশি ম্যানেজার হিসেবে অংশীদারের সম্মতিক্রমে বেতন নিতে পারবেন।

তাদের মতে, মুশারাকা কারবারে সকল অংশীদারই পুঁজির যোগান দানের বিনিময়ে লাভ-লোকসানের ভাগী হন এবং অংশীদারদের মধ্যে কেউ কারবার পরিচালনায় অংশ নিলে তিনি তার কাজের জন্য পারিশ্রমিক পাওয়ার হকদার।

মুশারাকা কারবারে কোন অংশীদার তার নিজস্ব কোন খরচ কারবার থেকে বহন করতে পারে না। কিন্তু কারবারের উদ্দেশ্যে অংশীদারের যাতায়াত, থাকা-খাওয়া ইত্যাদি খরচ বহন করবেন।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (IDB) মুশারাকার সংজ্ঞায় বলেছে :

Musharaka is an Islamic financing technique that adopts ‘ equity sharing’ as a means of financing projects. Thus, embraces different types of profit and loss sharing partnerships.

The partners (entrepreneurs, bankers etc.) share both capital and management of project so that profits will be distributed among them according to agreed ratio and loss is shared as per their equity participation (ratio).(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

অর্থাৎ মুশারাকা হলো মূলধনে অংশিদারিত্ব বা ইক্যুইটি শেয়ারিং-এর ভিত্তিতে কোন প্রকল্পে বিনিয়োগের একটি ইসলামী অর্থায়ন পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে লাভ- লোকসানভিত্তিক বিভিন্ন অংশীদারী কারবার গড়ে ওঠে।

এ প্রকল্পের লাভ বা ক্ষতি অংশীদারগণকে বহন করতে হয়। অংশীদারগণ (উদ্যোক্তা, ব্যাংক ইত্যাদি) প্রকল্পে মূলধন সরবরাহ করেন ও ব্যবস্থাপনায় অংশ নেন ৷(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

তাদের মধ্যে চুক্তির শর্তানুযায়ী লাভের অংশ এবং মূলধন অনুপাতে লোকসান বণ্টন হয়।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

The Accounting and Auditing Organization for Islamic Financial Institutions (AAOIFI) মুশারাকার সংজ্ঞায় বলেছে :

form of partnership between the Islamic Bank and its clients whereby each party contributes to the capital of partnership in equal or verifying degrees to establish a new project or share in an existing one, and whereby each of the parties becomes an owner the of the capital on a permanent or declining basis and shall have his due share of profits…

অর্থাৎ মুশারাকা হলো ইসলামী ব্যাংক এবং গ্রাহকের মধ্যে এক ধরনের অংশীদারি কারবার যেখানে প্রত্যেক অংশীদার সমান বা ভিন্ন মাত্রায় কোন নতুন কিংবা প্রতিষ্ঠিত প্রকল্পে মূলধন গঠনে অংশ নেয় এবং যেখানে প্রত্যেক অংশীদার স্থায়ী কিংবা ক্রমহ্রাসমান ভিত্তিতে মূলধনে মালিকানা লাভ করে এবং মুনাফায় প্রাপ্য অংশ পায়।

ব্যাংক কোম্পানী (সংশোধন) আইন, ১৯৯৫-এ মুশারাকার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে :

Musharaka means such an agreement under which a portion of capital of anything is provided by a bank conducted in accordance with the Islami Shariah and the other portion is given by the customer and in which profit in distributed in such proportion as mentioned in the agreement and loss is distributed in proportion to the capital.

“মুশারাকা” অর্থ এমন চুক্তি যাহার অধীন কোন কাজে মূলধনের এক অংশ ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক পরিচালিত কোন ব্যাংক এবং অপর অংশ গ্রাহক যোগান দেয় এবং যে কাজের লাভ চুক্তিতে উল্লিখিত অনুপাতে এবং লোকসান মূলধন অনুপাতে বণ্টিত হয়।

সেন্ট্রাল শরীয়াহ্ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস্ অব বাংলাদেশ কর্তৃক প্রণীত ও বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরিত ‘(প্রস্তাবিত) ইসলামী ব্যাংক কোম্পানি আইন’-এ মুশারাকার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে :

s,…“মুশারাকা” (Musharaka) এমন এক ব্যবসায়িক চুক্তিকে বুঝাইবে, যাহার অধীনে কোন কারবারে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে মূলধনের এক অংশ ব্যাংক কোম্পানি এবং অপর অংশ গ্রাহক যোগান দিবে। উক্ত ব্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জিত মুনাফা চুক্তিতে উল্লিখিত অনুপাতে এবং লোকসান মূলধন অনুপাতে বণ্টিত হইবে।

ব্যাংকিং কারবারে মুশারাকার বৈশিষ্ট্য

এটি একটি যৌথ মূলধনী কারবার। কারবারে প্রয়োজনীয় মূলধন যোগায় গ্রাহক ও ব্যাংক । মোট পুঁজির একটি অংশ গ্রাহক যোগান এবং অন্য অংশ দেয় ব্যাংক । উভয়ের পুঁজি সমান অথবা কম-বেশি হতে পারে।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

কোন প্রকল্প বা ব্যবসায়ে গ্রাহক ও ব্যাংকের মূলধনের হিস্যা বা পরিমাণ চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়।

চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ব্যবসায়ের লাভ গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে ভাগ হয়।

ব্যবসায়ের প্রকৃত লোকসান ব্যাংক ও গ্রাহক তাদের মূলধন অনুপাতে বহন করেন।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

মুশারাকা প্রকল্পে কোন অংশীদারকে চূড়ান্ত হিসেবের আগে অনুমানের ভিত্তিতে আগাম লাভ দেয়া যাবে। তবে আগাম দেয়া লাভ হিসাব চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রকৃত লাভ-ক্ষতির সাথে সমন্বয় করতে হবে।

অব্যবস্থাপনা, চুক্তিভঙ্গ, বিশ্বাসভঙ্গ ইত্যাদি কারণে লোকসান হলে দায়ী পক্ষকে তা বহন করতে হয়।

ব্যাংক মুশারাকা চুক্তিতে যেকোন যুক্তিসঙ্গত শর্ত আরোপ করতে পারে । যেমন, কোন গ্রাহক ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কোন পণ্য লোকসানে বেচতে পারবেন না।

গ্রাহক যথাযথ হিসাব সংরক্ষণ করবেন। ব্যাংক নিজে অথবা মনোনীত নিরীক্ষক দিয়ে এই হিসাব পরিদর্শন ও নিরীক্ষণ করাতে পারে।

এ ধরনের বিনিয়োগ সাধারণত তদারকিভিত্তিক হয়। নিয়মিত ও সুষ্ঠু তদারকির অভাবে মুশারাকা বিনিয়োগ ব্যর্থ হতে পারে।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

মুদারাবা ও মুশারাকার মধ্যে পার্থক্য

মুদারাবার ক্ষেত্রে ‘সাহিবুল মাল’ মূলধন সরবরাহ করেন এবং ‘মুদারিব’ তহবিলের ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেন। মুশারাকার ক্ষেত্রে চুক্তিভুক্ত সকল পক্ষ মূলধন গঠনে অংশ নেন।

মুদারাবা পদ্ধতিতে ‘সাহিবুল মাল’ ব্যবসা পরিচালনায় অংশ নেন না। মুশারাকা পদ্ধতিতে অংশীদারগণ সকলেই ব্যবসা পরিচালনায় অংশ নিতে পারেন অথবা সকলের পক্ষে কিছু অংশীদার কারবার পরিচালনা করতে পারেন।

মুদারাবা পদ্ধতিতে পুঁজির লোকসান ‘সাহিবুল মাল’ বহন করেন। মুশারাকা পদ্ধতিতে পুঁজির ক্ষতি মূলধনের আনুপাতিক হারে সকল অংশীদারকে বহন করতে হয়।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

খ. ভাড়ায় ক্রয় পদ্ধতি

হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিল্‌ল্ক (HPSM)

‘হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক’ হলো এক বিশেষ সমন্বিত চুক্তি । অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এ পদ্ধতির উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে এটি ১. মালিকানায় শরীকানা, ২. ইজারা ও ৩. বিক্রি-এই তিন চুক্তির সমন্বয়।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর শরীয়াহ কাউন্সিলের মতে :

“মালিকানার অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে হায়ার পারচেজ (হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিল্‌ক বা ইজারা বিল বাই’ তাহতা শিরকাতুল মিল্ক) শরীয়াসম্মত একটি বিনিয়োগ পদ্ধতি। এর প্রধান শর্তগুলো নিম্নরূপ:

ক. মূলধন অনুপাতে অংশীদারগণের মালিকানার স্বীকৃতি দেয়া যাতে পরবর্তীতে তাদের বা তাদের ওয়ারিসগণের বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে।

খ. “ক্রেতাকে তার পরিশোধিত মূল্যের আনুপাতিক মালিকানা ব্যাংক কর্তৃক হস্তান্তর করা । ”(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

শিরকাতুল মিল্‌ক বা মালিকানায় শরীকানা

‘শিরকাত’ অর্থ অংশীদারী। ‘শিরকাতুল মিলক’ মানে মালিকানায় শরীকানা । এ ধরনের শরীকানা কারবারে দুই বা তারচে’ বেশি ব্যক্তি তাদের মূলধনে কোন সম্পদ কিনেন এবং যৌথভাবে তার ওপর মালিকানা লাভ করেন।

ব্যবসায়ের লাভ সকল পক্ষ চুক্তি অনুযায়ী ভাগ করে নেন আর লোকসান হলে মূলধন অনুপাতে বহন করেন । এ ধরনের চুক্তিকে বলা হয় ‘শিরকাতুল মিলক’।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

ইজারা

আরবী ‘আজর’ এবং ‘উজরাত’ শব্দ হতে ‘ইজারা’ পরিভাষাটি উদ্ভূত। ‘আজর’ মানে প্রতিদান, লাভ, মজুরী বা ভাড়া। ইজারা হলো কোন সম্পদ ব্যবহারের বিনিময় মূল্য বা প্রতিদান, লাভ, মজুরী বা সেবার ভাড়া।

ভাড়াদাতা ও ভাড়াগ্রহীতার মধ্যে ইজারা চুক্তি সম্পাদিত হয়। এ চুক্তি অনুযায়ী ভাড়াগ্রহীতা ভাড়াদাতার সম্পদের ব্যবহার বা সুবিধা গ্রহণ করেন। বিনিময়ে ভাড়াদাতাকে নির্দিষ্ট অর্থ দেন।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

বিক্রি

‘বিক্রয়’ হলো ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে চুক্তি। এ চুক্তির মারফতে বিক্রেতার মালিকানাধীন কোন নির্দিষ্ট পণ্য বা সম্পদ নির্ধারিত মূল্য নগদ বা আগাম বা ভবিষ্যতে পরিশোধের শর্তে ক্রেতার মালিকানায় ন্যস্ত হয়।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

তিন চুক্তির সমাহার

‘হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক’ পদ্ধতিতে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয় পক্ষ-

প্রথমত সম বা অসম পুঁজি বিনিয়োগ করে কোন সম্পদ (ভূমি, দালান, যন্ত্রপাতি, যানবাহন ইত্যাদি) কিনে যৌথভাবে সে সম্পদের ওপর মালিকানা লাভ করেন। তারা উক্ত সম্পদের আয় পূর্বনির্ধারিত হারে ভাগ করে নেন। আর্থিক ক্ষতি হলে উভয় পক্ষ পুঁজির অনুপাতে তা বহন করেন।

দ্বিতীয়ত এরূপ সম্পদে ব্যাংক তার অংশ গ্রাহকের কাছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট হারে ভাড়া দেয়।

তৃতীয়ত ব্যাংক তার অংশ কিস্তিতে বা এককালীন নির্ধারিত মূল্যে ভাড়াকালীন সময়ব্যাপী বা ভাড়া চুক্তির শেষে গ্রাহকের কাছে বিক্রি ও হস্তান্তর করে।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর ম্যানুয়েলে ‘হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক্’ সম্পর্কে বলা হয়েছে :

এ পদ্ধতিতে ব্যাংক ও গ্রাহক চুক্তির ভিত্তিতে যৌথভাবে যানবাহন, মেশিন ও যন্ত্রপাতি, ভবন, এপার্টমেন্ট ইত্যাদি ক্রয় করে। গ্রাহক ভাড়ার ভিত্তিতে তা ব্যবহার করেন এবং ব্যাংকের অংশের মূল্য কিস্তিতে পরিশোধ করে পর্যায়ক্রমে তার মালিকানা অর্জন করেন।

পণ্য বা মালামাল ক্রয়ের আগে এর প্রকৃত মূল্য, মাসিক ভাড়া, ব্যাংকের অংশের মূল্য, পরিশোধের সময়সীমা ও কিস্তির পরিমাণ এবং জামানতের প্রকৃতি প্রভৃতি নির্ধারণ করে চুক্তি সম্পাদিত হয়।

বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো ব্যাংক এই বিনিয়োগপদ্ধতিকে ‘হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক্’ বা ‘HPSM’ হিসেবে অভিহিত করে। তবে এক্সিম ব্যাংকে এ পদ্ধতির নাম ‘ইজারা বিল বাই’ বা ‘IBB’।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতি ‘আল ইজারা আল মুনতাহিয়াতু বিত্ তামলীক’ বা ljarah Muntakia Bittamleek হিসেবে পরিচিত।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিল্‌ল্ক-এর বৈশিষ্ট্য

গ্রাহক তার চাহিদা অনুযায়ী কোন নির্দিষ্ট সম্পদ কেনার ইচ্ছা জানিয়ে ব্যাংকের কাছে আবেদন করেন। ব্যাংকের মঞ্জুরি লাভের পর গ্রাহক তার অংশের পুঁজি বা ইক্যুইটি ব্যাংকে জমা করেন। গ্রাহকের এই টাকার সাথে ব্যাংক তার অংশের টাকা যোগ করে সম্পদের পুরো দাম পরিশোধ করে।

রূপ সম্পদ কেনার আগে মোট দাম, মাসিক ভাড়া, ব্যাংকের অংশ, পরিশোধের সময়সীমা ও কিস্তির পরিমাণ, জামানতের ধরন প্রভৃতি নির্ধারণ করে পক্ষগণের মধ্যে চুক্তি হয়।

ব্যাংক যৌথ মালিকানাধীন এ সম্পদে তার নিজের অংশটি গ্রাহকের কাছে চুক্তির শর্ত অনুসারে ভাড়া দেয় ৷

গ্রাহক নির্ধারিত ভাড়া ও ব্যাংকের অংশের মূল টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করেন।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

গ্রাহকের কিস্তি পরিশোধের ফলে সম্পদে ব্যাংকের মালিকানার অংশ কমতে থাকে। গ্রাহকের মালিকানা সে অনুপাতে বাড়তে থাকে।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

গ্রাহকের মালিকানা বাড়ার সাথে সাথে ব্যাংকের প্রাপ্য ভাড়ার পরিমাণ আনুপাতিক হারে কমে আসে।

সম্পদে ব্যাংকের অংশের মূল্য পুরো শোধ হলে গ্রাহক তাতে পূর্ণ মালিকানা লাভ করেন।

মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ব্যাংকের অংশের পুরো দাম শোধ করে গ্রাহক সম্পদের পূর্ণ মালিকানা পেতে পারেন।

গ্রাহক নির্ধারিত কিস্তি দিতে ব্যর্থ হলে ব্যাংকের মালিকানার অনুপাত অনুযায়ী ভাড়া অব্যাহত থাকে।

চুক্তির শর্ত পালনে গ্রাহক ব্যর্থ হলে ব্যাংক সম্পদ নিজ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে।

ভাড়া হিসেবে পাওয়া অর্থ ব্যাংকের আয়। ভাড়ার টাকা মালিকানার অংশের সাথে যুক্ত নয়।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

গৃহনির্মাণ বিনিয়োগে এইচপিএসএম

হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিল্ক পদ্ধতিতে গৃহনির্মাণ খাতে এ বিনিয়োগ করার ব্যাপারে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর শরীয়াহ কাউন্সিল নিম্নোক্ত নীতিসমূহ অনুমোদন করেছে :

১. গ্রাহক কর্তৃক প্রস্তাবিত জমির ওপর অনুমোদিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যাংক নির্মাণ কাজ করতে পারে এবং হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিল্‌ক অথবা ইজারা চুক্তির অধীনে ক্রমহ্রাসমান মালিকানা পদ্ধতিতে পর্যায়ক্রমে ভাড়া ও মূল্য আদায়ের মাধ্যমে গ্রাহকের নিকট মালিকানা হস্তান্তর করতে পারে অথবা ভাড়ার মেয়াদ শেষে একসাথে পূর্ণ দাম আদায়ের মাধ্যমে মালিকানা হস্তান্তর করতে পারে।

২. ব্যাংক গ্রাহকের অনুরোধক্রমে তারই প্রদত্ত জমিতে অনুমোদিত পরিকল্পনা অনুসারে ভবন নির্মাণ করার চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারে এবং নির্মিত ভবনের বিক্রয়মূল্য কিস্তিতে অথবা এককালীন পরিশোধের শর্তে বাই- মুয়াজ্জাল পদ্ধতিতে গ্রাহকের নিকট বিক্রয় করতে পারে।

৩. ব্যাংক সরাসরি জমি ক্রয় করে তার ওপর পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করে বাই-মুয়াজ্জাল পদ্ধতিতে আগ্রহী ক্রেতাদের নিকট কিস্তিতে বা এককালীন বিক্রি করতে পারে।

8. ব্যাংক অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী এককালীন এসটিমেট করে শুধুমাত্র নির্মাণসামগ্রী ক্রয় করে সংশ্লিষ্ট বাড়ি নির্মাণের পর বাই-মুয়াজ্জাল পদ্ধতিতে বিক্রি করতে পারে।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

গ. বেচা-কেনা পদ্ধতি

আরবী ‘বাই’ ও ‘রিবহুন’ শব্দ থেকে ‘বাই-মুরাবাহা’ পরিভাষাটি উদ্ভূত। ‘বাই’ অর্থ কেনা-বেচা। ‘রিবহুন’ অর্থ লাভ বা মুনাফা। সহজ কথায় ‘বাই-মুরাবাহা’ হচ্ছে লাভে বিক্রয় বা মুনাফায় বিক্রয়।

ব্যাংকিং ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ‘মুরাবাহা’ এমন এক ব্যবসায়িক চুক্তি, যার অধীনে ব্যাংক তার গ্রাহকের অনুরোধে নির্ধারিত মাল কিনে ক্রয়মূল্যের সাথে সম্মত লাভ যোগ করে তা সেই গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে। গ্রাহক চুক্তির শর্তানুসারে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মূল্য শোধ করে মাল নিতে বাধ্য থাকেন।

ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি
(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (IDB) ‘বাই-মুরাবাহা’র সংজ্ঞায় বলেছে :

Murabaha is a contract between a buyer and a seller at a higher price than the original price at which the seller bought the goods as a financing technique, it involves the purchase by the seller (financier) of certain goods needed by the buyer and their re-sale to the buyer on cost-plus basis.

Both the profit (mark-up ) and the time of repayment (usually in installments) are specified in the initial contract.”

অর্থাৎ বাই-মুরাবাহা হলো ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে একটি চুক্তি যেখানে বিক্রেতা (অর্থায়নকারী) ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রি করে।

এ ক্ষেত্রে বিক্রেতা অর্থায়ন কৌশল হিসেবে ক্রেতার প্রয়োজন অনুযায়ী কোন নির্দিষ্ট পণ্য ক্রয় করে এবং ‘মুনাফা সংযোজন’ করে প্রকৃত কেনা দামের চেয়ে উচ্চতর মূল্যে তা ক্রেতার কাছে বিক্রি করে। চুক্তিতে লাভ (মার্ক-আপ) এবং মূল্য পরিশোধের সময় (সাধারণত কিস্তিতে) নির্ধারিত থাকে।

সকল ইসলামী ব্যাংকের কর্মকৌশল অভিন্ন ধারায় পরিচালনার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত বাহরাইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা Accounting and Auditing Organization for Islamic Financial Institutions (AAOIFI) ‘বাই- মুরাবাহা’র সংজ্ঞায় বলেছে :

Murabaha is selling a commodity as per the purchasing price with a defined and agreed profit mark-up. This mark-up may be a percentage of the selling price or a lump sum.

This transaction may be concluded either without a prior promise to buy, in which case it is called an ordinary Murabaha, or with a prior promise to buy submitted by a person interested in acquiring goods through the institution, in which case it is called a “banking Murabaha” i.e. Murabaha to the purchase orderer.

This transaction is one of the trust-based contracts that depends on transparency as to the actual purchasing price or cost price in addition to common expenses.

অর্থাৎ মুরাবাহা হলো নির্ধারিত ও সম্মত লাভের ভিত্তিতে পণ্য বিক্রি । এই লাভ (মার্ক-আপ) বিক্রয় মূল্যের হারাহারি হতে পারে কিংবা তা ‘থোক’ (lump sum) হতে পারে ।

কেনার ওয়াদা ছাড়া এ লেনদেন সম্পন্ন হলে তা হবে একটি সাধারণ মুরাবাহা চুক্তি। কোন আগ্রহী ব্যক্তি কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পণ্য কেনার জন্য আগাম পেশ করা ওয়াদাপত্রের ভিত্তিতে এ লেনদেন হলে তা ‘ব্যাংকিং মুরাবাহা’ বা ক্রয়-আদেষ্টার কাছে লাভে পণ্য বিক্রি (মুরাবাহা ) হিসেবে গণ্য হবে।

এরূপ লেনদেনে প্রকৃত ক্রয়মূল্য বা Cost price-এর সাথে সাধারণ খরচাদি আলাদাভাবে উল্লেখ থাকায় এ চুক্তি স্বচ্ছতানির্ভর আস্থাভিত্তিক চুক্তিসমূহের পর্যায়ভুক্ত।

সেন্ট্রাল শরীয়াহ্ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস্ অব বাংলাদেশ কর্তৃক প্রণীত ও বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরিত ‘(প্রস্তাবিত) ইসলামী ব্যাংক কোম্পানি আইন’-এ বলা হয়েছে:

بيع المرابحة “বাই মুরাবাহা” (Bai-Murabaha) বলিতে এমন এক ব্যবসায়িক চুক্তিকে বুঝাইবে যাহার অধীনে ব্যাংক বিনিয়োগ গ্রাহকের অনুরোধে নির্ধারিত মালামাল ক্রয় করিয়া ক্রয়মূল্যের সহিত উভয়ের সম্মতির ভিত্তিতে নির্ধারিত লাভ যুক্ত করিয়া তাঁহার নিকট বিক্রয় করিবে।

বিনিয়োগ গ্রাহক চুক্তির শর্তানুসারে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিক্রয়মূল্য পরিশোধ করিয়া মালামাল গ্রহণ করিতে বাধ্য থাকিবে। এই চুক্তিতে পণ্যের প্রকৃত ক্রয়মূল্য উল্লেখ করিতে হইবে।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

ব্যাংকিং কারবারে মুরাবাহা বিনিয়োগের বৈশিষ্ট্য

১. ব্যাংকিং মুরাবাহায় তিনটি পক্ষ থাকে : ১. ব্যাংক (অর্থায়নকারী), ২. বিক্রেতা (যার কাছ থেকে ব্যাংক মাল কিনে) এবং ৩. ক্রেতা বা গ্রাহক (যার কাছে ব্যাংক মাল বেচে)।

২. বিনিয়োগ প্রস্তাব বিবেচনার সময় ব্যাংক গ্রাহকের ব্যবসায়িক যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, বিশ্বস্ততা, বাজারে তাঁর সুনাম ইত্যাদির ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেয়।

৩. গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য কেনার আগে বাজারে সেই মালের কাটতি, মূল্য, সম্ভাব্য মুনাফা ইত্যাদি ব্যাপারে সতর্কতার সাথে যাচাই করে দেখা ব্যাংকের দায়িত্ব।

৪. পণ্যের কেনা দাম ও লাভের অংক ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়েরই জানা থাকা মুরাবাহা পদ্ধতির একটি শর্ত।

৫. পণ্যের প্রকৃত কেনা দামের সাথে পরিবহন ও আনুষঙ্গিক খরচ যোগ করে নীট ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়। ব্যাংক এই নীট ক্রয়মূলের ওপর সম্মত লাভ যোগ করে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে।

৬. ব্যাংক মাল রাখার জন্য গুদাম ভাড়া, গুদাম কর্মচারীদের বেতন, বীমার প্রিমিয়াম ইত্যাদি খরচ গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করে।

৭. ব্যাংক একই ধরনের অতিরিক্ত মাল গ্রাহকের কাছ থেকে জামানত নিতে পারে।

৮. ব্যাংক প্রয়োজনে গ্রাহকের কাছ থেকে সহায়ক জামানত নিতে পারে।

৯. গ্রাহক সম্পূর্ণ দাম শোধ করে সব মাল একসাথে নিতে পারেন বা কিস্তিতে আনুপাতিক দাম দিয়ে আংশিক মাল নিতে পারেন।

১০. বিনিয়োগ করা পণ্যের মালিকানা গ্রাহকের কাছে ন্যস্ত হয়।

১১. চুক্তি অনুযায়ী গ্রাহক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্যের সরবরাহ নিতে ও দাম শোধ করতে বাধ্য থাকেন।

১২. বিক্রয়-চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর শর্তের কোন পরিবর্তন করা যায় না ৷(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

বাই মুয়াজ্জাল

আরবী ‘বাই’ এবং ‘আজল’ শব্দ থেকে বাই-মুয়াজ্জাল পরিভাষাটি উদ্ভুত। ‘বাই’ অর্থ কেনা-বেচা। ‘আজল’ অর্থ নির্ধারিত সময়। বাই-মুয়াজ্জাল অর্থ ভবিষ্যতে পরিশোধের শর্তে পণ্য বিক্রয়। এটি বাকিতে পণ্য বিক্রয়ের চুক্তি।

‘বাই-মুয়াজ্জাল’ বলতে ব্যাংক কর্তৃক মুনাফার উদ্দেশ্যে গ্রাহকের নিকট বাকিতে মাল বেচা বোঝায় । ব্যাংক পণ্য কিনে তার ওপর মালিকানা নিশ্চিত করার পর চুক্তির শর্ত অনুযায়ী গ্রাহককে সম্মত মূল্যে সেই পণ্য সরবরাহ করে।

চুক্তিতে পণ্যের ধরন, মান, পরিমাণ, বিক্রয়মূল্য, পণ্য সরবরাহের স্থান ও সময়, দাম পরিশোধের সময়সীমা ও পদ্ধতি ইত্যাদি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকে।

সেন্ট্রাল শরীয়াহ্ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস্ অব বাংলাদেশ কর্তৃক প্রণীত ও বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরিত ‘(প্রস্তাবিত) ইসলামী ব্যাংক কোম্পানি আইন’-এ বাই-মুয়াজ্জালের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে :

بيع المؤجل “বাই” মুয়াজ্জাল” ( Bai – Muazzal) বলিতে ব্যাংক ও গ্রাহকের মধ্যে সম্পাদিত এমন এক বিক্রয় চুক্তিকে বুঝাইবে, যেখানে গ্রাহকের ফরমায়েশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট কোন পণ্য উভয়ের সম্মতির ভিত্তিতে নির্ধারিত মূল্যে গ্রাহকের নিকট বাকিতে বিক্রয় করা হইবে। এই চুক্তিতে ব্যাংক গ্রাহকের কাছে পণ্যের প্রকৃত ক্রয়মূল্য প্রকাশ করিতে বাধ্য নহে।

বাই-মুয়াজ্জালের বৈশিষ্ট্য

১. এই পদ্ধতিতে ব্যাংক গ্রাহকের অনুরোধে কৃষি ও শিল্পের বিভিন্ন উপকরণ, ভোগ্যপণ্য ও মাল কিনে তা গ্রাহকের কাছে বাকীতে বিক্রয় করে।

২. গ্রাহক চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে মালের নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করেন।

৩. ব্যাংক পণ্য কিনে তাতে মালিকানা নিশ্চিত করে চুক্তি অনুযায়ী গ্রাহককে সম্মত মূল্যে সে পণ্য সরবরাহ করে।

৪. চুক্তিতে পণ্যের ধরন, মান, পরিমাণ, বিক্রয়মূল্য, সরবরাহের স্থান ও সময়, গ্রাহক কর্তৃক মূল্য পরিশোধের সময়সীমা ও পদ্ধতি ইত্যাদি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়।

৫. বাই-মুয়াজ্জাল বিনিয়োগে ব্যাংক গ্রাহকের কাছে পণ্যের কেনা দাম প্ৰকাশ করতে বাধ্য নয়।

৬. ব্যাংক ও গ্রাহক উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে পণ্যের বিক্রয়-মূল্য নির্ধারিত হয় । পণ্যের বিক্রয়মূল্য নির্ধারিত হওয়ার পর তা পরিবর্তন করা যায় না।

৭. ব্যাংক এ বিনিয়োগ নিরাপদ করতে গ্রাহকের কাছ থেকে সহায়ক জামানত নিয়ে থাকে।

৮. নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গ্রাহক পণ্যের দাম শোধ করতে ব্যর্থ হলে ব্যাংক অতিরিক্ত কোন অর্থ আদায় করতে পারে না। তবে গ্রাহকের কাছ থেকে শর্তানুযায়ী ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারে। আদায়কৃত ক্ষতিপূরণের অর্থ ব্যাংক নিজের আয়রূপে গণ্য করে না। শরীয়াহ্ কাউন্সিল কর্তৃক অনুমোদিত কোন জনহিতকর কাজে সে অর্থ ব্যয় করা হয়।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

বাই-মুয়াজ্জাল ও বাই-মুরাবাহার মধ্যে পার্থক্য

মুরাবাহা চুক্তিতে পণ্যের কেনা দাম, মুনাফা ও অন্যান্য খরচ আলাদাভাবে উল্লেখ করা অপরিহার্য। বাই-মুয়াজ্জাল চুক্তির বেলায় এসব তথ্য জানানো বাধ্যতামূলক নয়। শুধু বিক্রয়মূল্য ঘোষণা করলেই চলে। বাই-মুয়াজ্জাল পদ্ধতির অন্যান্য শর্ত মুরাবাহা চুক্তির মতো।

বাই-মুরাবাহা ও বাই-মুয়াজ্জাল পদ্ধতির কয়েকটি সাধারণ শর্ত হলো :

১. গ্রাহকের কাছে বিক্রির আগেই সংশ্লিষ্ট মাল ব্যাংকের মালিকানায় ও দখলে থাকতে হবে। শরীয়ার বিধান অনুসারে যা নিজের মালিকানায় নেই, তা বিক্রি করা যায় না ৷

২. মাল ক্রয়ের পর থেকে ক্রেতার কাছে হস্তান্তর করার আগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মালের হারিয়ে যাওয়া, চুরি যাওয়া, নষ্ট হওয়া ইত্যাদি যেকোন ক্ষয়-ক্ষতির দায়িত্ব ব্যাংক (বিক্রেতা) বহন করবে। শরীয়ার দৃষ্টিতে ঝুঁকি বহন না করে মুনাফা করা বৈধ নয়।

৩. গ্রাহকের ফরমায়েশ অনুযায়ী মাল কেনার যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের দায়িত্ব ব্যাংক বা তার প্রতিনিধির। সে প্রতিনিধি কোনক্রমেই ফরমায়েশ দানকারী ক্রেতা হবে না। মালের পরিবহন ও বিক্রির আগ পর্যন্ত সংরক্ষণের দায়িত্ব ব্যাংকের।

৪. বাই-মুয়াজ্জাল ও মুরাবাহা পদ্ধতিতে একবার পণ্যের দাম ঠিক হলে তা আর পরিবর্তন করা যায় না। ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে ক্রেতা দেরি করলে অতিরিক্ত সময়ের লাভের হার বা দাম বাড়ানো যাবে না।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

বাই-সালাম

“আরবী ‘বাই’ অর্থ কেনা-বেচা। ‘সালাম’ অর্থ আগাম। ‘বাই-সালাম’ হলো ‘আগাম কেনা-বেচা”।

‘বাই-সালাম’ এমন এক ব্যবসায়িক চুক্তি যার আওতায় আগামী কোন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহের শর্তে ব্যাংক মালের দাম আগাম পরিশোধ করে । নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাংক গ্রাহকের কাছ থেকে পণ্য সরবরাহ নিয়ে তা যে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে বেচতে পারে।

Accounting and Auditing Organisation for Islamic Financial Institutions (AAOIFI) ‘বাই-সালাম’-এর সংজ্ঞায় বলেছে :

A Salam transaction is the purchase of a commodity for deffered delivery in exchange for immediate payment.

It is a type of sale in which the price, known as the Salam capital, is paid at the time of contracting while the delivery of the item to be sold, known as al-Muslam fihi (the subject matter of a Salam contract), is deffered.

The seller and the buyer are known as al-Muslam ilaihi and al- Muslam or Rabb al-Salam respectively. Salam is also known as salaf (lit. borrowing). “

অর্থাৎ “সালাম লেনদেন হলো আগাম দাম শোধের বিপরীতে ভবিষ্যতে সরবরাহের শর্তে পণ্য ক্রয়। এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে সরবরাহ করা হবে এমন পণ্যের (মুসলাম ফিহি বা সালাম চুক্তির বিষয়বস্তু) বিপরীতে পণ্যের দাম বা সালাম মূলধন চুক্তির সময় আগাম পরিশোধ করা হয়।

বিক্রেতাকে বলা হয় ‘মুসলাম ইলাইহি’ এবং ক্রেতাকে বলা হয় ‘আল মুসলাম’ বা ‘রব্বুস সালাম’। সালাম চুক্তি সালাফ নামেও পরিচিত (আভিধানিক অর্থ ধার করা)।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

সেন্ট্রাল শরীয়াহ্ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস্ অব বাংলাদেশ কর্তৃক প্রণীত ও বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরিত ‘(প্রস্তাবিত) ইসলামী ব্যাংক কোম্পানি আইন’-এ বাই-সালামের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে :

السليم “বাই’ সালাম” (Bai-Salam) বলিতে এমন এক ক্রয়- ‘বিক্রয় চুক্তিকে বুঝাইবে, যেখানে ভবিষ্যতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য/মালামাল সরবরাহ করিবার শর্তে ব্যাংক গ্রাহকের সহিত তাহার সম্মতির ভিত্তিতে নির্ধারিত ক্রয়মূল্য আগাম পরিশোধ করিবে। এই চুক্তি সম্পাদনের সময় পণ্যের গুণগত মান, পরিমাণ, ধরন, সরবরাহের স্থান ও সময় উল্লেখ করিতে হইবে।

বাই-সালামের বৈশিষ্ট্য

১. এ পদ্ধতিতে ব্যাংক সাধারণতঃ কৃষি ও শিল্পপণ্য আগাম কিনে।

২. এ পদ্ধতিতে ব্যাংক হচ্ছে ক্রেতা এবং গ্রাহক এক্ষেত্রে বিক্রেতা।

৩. ব্যাংক এ ধরনের চুক্তি সম্পাদনের পর গ্রাহককে মালের আগাম মূল্য বাবদ অর্থ (সালাম মূলধন) যোগান দেয়।

৪. চুক্তির সময় ব্যাংক ও গ্রাহকের সম্মতির ভিত্তিতে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা হয়।

৫. চুক্তির সময় পণ্যের মান, শ্রেণী, পরিমাণ, সরবরাহের সময়, স্থান ও ধরন স্থির করা হয়।

৬. চুক্তি অনুযায়ী গ্রাহক ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য সরবরাহ করেন।

৭. পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে বিক্রেতা আগাম নেয়া দাম ফেরত দেবেন।

৮. ব্যাংক নির্দিষ্ট সময়ে গ্রাহকের কাছ থেকে পণ্য সরবরাহ নিয়ে তা যেকোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে বেচতে পারে।ৎ

৯. ব্যাংক সময় মতো যথাযথ পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে সহায়ক জামানত নিতে পারে।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

ইসতিসনা

ইসতিসনা হলো ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে একটি চুক্তি। এ চুক্তি অনুযায়ী ক্রেতার নির্দেশে বিক্রেতা কোন বস্তু তৈরি করে দেয়ার অঙ্গীকার করেন।

কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তার চাহিদামতো কোন দ্রব্য নির্ধারিত দামের বিনিময়ে তৈরি করে দিতে কোন কারিগর বা কারখানা মালিকের নিকট প্রস্তাব করলে এবং কারিগর বা মালিক ঐ প্রস্তাবে রাজি হলে ‘ইসতিসনা’ চুক্তি সম্পাদিত হয়।

এ ক্ষেত্রে আদেশদাতাকে বলা হয় ‘মুসতাসনি’। আদেশগ্রহীতা হলেন ‘সানে’ । আদেশের মাধ্যমে তৈরি করা পণ্যকে বলা হয় ‘মাসনু’।

অর্ডারের বিপরীতে নির্মাণ বা তৈরি করা হয় এমন জিনিস নির্মাণ বা তৈরি করে দিতে আদেষ্টা আদেশ দিলে এবং আদিষ্ট তাতে সম্মত হলে তা ‘ইসতিসনা’ চুক্তি হবে। আজল বা মেয়াদ নির্ধারণ করা ‘ইসতিসনা’ চুক্তিতে জরুরি নয়। তবে ব্যাংক ও গ্রাহকের মধ্যে বিরোধ এড়াতে মেয়াদ নির্ধারণ করা ভালো।

অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড অডিটিং অর্গানাইজেশন ফর ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন্স (AAOIFI) ইসতিসনার সংজ্ঞায় বলেছে :

Istisna’a is a contract of sale of specified items to be manufactured or constructed, with an obligation on the part of the manufacturer or builder (contractor) to deliver them to the customer upon completion.

অর্থাৎ “ইসতিসনা হলো কোন নির্দিষ্ট পণ্য উৎপাদন বা নির্মাণ করে বিক্রয়ের চুক্তি, যাতে উৎপাদনকারী বা নির্মাতা (কনট্রাকটর) কর্তৃক উক্ত পণ্য তৈরি বা নির্মাণের পর গ্রাহককে সরবরাহ করার বাধ্যবাধকতা থাকে।

ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (IDB) ইসতিসনার সংজ্ঞায় বলেছে :

Istisna is a contract for manufacturing (or construction) whereby the manufacturer (seller) agrees to provide the buyer with goods identified by description after they have been manufactured/constructed in conformity with that description within a certain time and for an agreed price.

অর্থাৎ “ইসতিসনা হলো উৎপাদনের (বা নির্মাণের) এমন এক চুক্তি যেখানে উৎপাদনকারী (বিক্রেতা) নির্দিষ্ট বিবরণ অনুযায়ী কোন পণ্য তৈরি করে তা নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত দামে ক্রেতাকে সরবরাহ করতে সম্মত হয়।”

সেন্ট্রাল শরীয়াহ্ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস্ অব বাংলাদেশ কর্তৃক প্রণীত ও বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরিত ‘(প্রস্তাবিত) ইসলামী ব্যাংক কোম্পানি আইন’-এ ইসতিসনার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে :

Ele~!“ইসতিসনা” (Istisnaa) বলিতে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সম্পাদিত এমন চুক্তিকে বুঝাইবে যাহাতে ক্রেতা কর্তৃক নির্দেশিত বস্তু বিক্রেতা কর্তৃক তৈয়ারি করিয়া সরবরাহ করিবার অঙ্গীকার থাকে।

কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কোন কারিগর বা কারখানার মালিকের নিকট তাহার উদ্দিষ্ট দ্রব্য নির্ধারিত মূল্যের বিনিময়ে প্রস্তুত করিয়া দেওয়ার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে কারিগর বা মালিক উক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করিলে ইসতিসনা চুক্তি সম্পাদিত হয়।

এই চুক্তিতে কাঙ্ক্ষিত পণ্যের মূল্য, ধরন, শ্রেণী, পরিমাণ, বৈশিষ্ট্য, মূল্য পরিশোধের প্রক্রিয়া, পণ্য সরবরাহের স্থান, সময় ও বহন খরচ ইত্যাদির বিস্তারিত বিবরণ থাকিতে হইবে। এতদ্ব্যতীত, ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের সম্মতিক্রমে পণ্যের আংশিক বা পূর্ণ মূল্য আগাম প্রদান করা যাইতে পারে।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

ইসতিসনার বৈশিষ্ট্য

১. ‘ইসতিসনা’ চুক্তিতে পণ্যের স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট বিবরণ থাকতে হবে। পণ্যের ধরন, শ্রেণী, পরিমাণ ও বৈশিষ্ট্য চুক্তিতে উল্লেখ করা জরুরি। এর ফলে পরবর্তীতে কোন ভুল বুঝাবুঝি বা বিবাদ এড়ানো যাবে।

2. চুক্তিতে সম্মত দাম উল্লেখ করতে হবে। দাম কখন কিভাবে পরিশোধ করা হবে তাও চুক্তিতে উল্লেখ থাকবে।

৩. পণ্য কখন, কোথায়, কার খরচে সরবরাহ করা হবে তার উল্লেখ চুক্তিতে থাকতে হবে।

৪. পক্ষগণ রাজি হলে বিক্রেতাকে পণ্যের আংশিক বা পুরা দাম আগাম দেয়া যেতে পারে অথবা বাকি রাখা যেতে পারে।

৫. ‘ইসতিসনা’ চুক্তিতে মাল সরবরাহের সময়সীমা নির্ধারণ জরুরি নয়। মেয়াদ নির্ধারণ না করেও ইসতিসনা চুক্তি করা যায়। তবে বিরোধ এড়ানোর জন্য ব্যাংকের ক্ষেত্রে মেয়াদ নির্ধারিত করা ভালো।

৬. চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর পণ্যের পূর্ণ বা আংশিক দাম শোধ হওয়ার পর কোন পক্ষ এককভাবে চুক্তি বাতিল বা প্রত্যাহার করতে পারবেন না।

৭. কোন পক্ষ ইচ্ছাকৃত চুক্তি ভঙ্গ করলে দায়ী পক্ষের ওপর নির্দিষ্ট জরিমানা আরোপ করা যাবে । এরূপ শর্ত ইসতিসনা চুক্তিতে রাখা যাবে।

৮. সমকালীন ফক্বীহগণের মতে ইসতিসনার ক্ষেত্রে আরোপিত ক্ষতিপূরণ ব্যাংকের বৈধ আয়রূপে বিবেচিত হবে।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

বাই-সালাম ও ইসতিসনার মধ্যে পার্থক্য

১. বাই-সালাম বা আগাম ক্রয়ের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে পণ্য সরবরাহ করা হয়। পণ্যের দাম চুক্তির সময় শোধ করতে হয়। ইসতিসনার ক্ষেত্রে পণ্যের আংশিক বা পুরা দাম আগাম কিংবা পণ্য সরবরাহের সময় পরিশোধ করা যায়।

২. বাই-সালাম সাধারণত কৃষিপণ্য আগাম কেনার চুক্তি। কিন্তু ইসতিসনার সম্পর্ক শিল্পপণ্যের উৎপাদন বা নির্মাণের সাথে। কোন কোন ইসলামী ব্যাংক পোশাক শিল্পের প্রাক-রফতানী কাজে অর্থায়নের বেলায় ইসতিসনা পদ্ধতি অনুসরণ করেন।

এমনি কিছু পার্থক্য সত্ত্বেও কোন কোন ফক্বীহ ইসতিসনাকে বাই-সালাম চুক্তির সম্প্রসারিত রূপ বলে মনে করেন।(ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি)

আরো জানুন: ইসলামী ব্যাংকের জমা গ্রহণের নীতি ও পদ্ধতি

One thought on “ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রদানের নীতি ও পদ্ধতি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.