ইসলামী ব্যাংকিং: সমালোচনা ও বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংকিং তুলনামূলকভাবে একটি নতুন ধারণা। সুদভিত্তিক প্ৰচলিত ব্যাংকব্যবস্থার বিপরীতে এ নতুন ধারণাকে সকলে একইভাবে গ্রহণ করবেন, এটা আশা করা যায় না। ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে নানাজন বিভিন্ন অবস্থান থেকে দেখেন এবং তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এ সম্পর্কে মূল্যায়ন করেন।

Table of Contents

ইসলামী ব্যাংক সম্পর্কে সাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি

১. কারো বিবেচনায় ইসলামী ব্যাংকিং একটি অবাস্তব ধারণা। কেননা ব্যাংকের সাথে সুদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কাজেই সুদ ছাড়া যারা ব্যাংকিং করতে চান, তাদের সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবার নয়।(ইসলামী ব্যাংকিং)

ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে তারা দূর থেকে তীর ছোঁড়ার মতো করে নানা ধরনের বিরূপ মন্তব্য করে থাকেন। তাদের সমালোচনায় তাদের পূর্ব-ধারণারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

তারা বলেও বেড়ান যে, সুদভিত্তিক ব্যাংক সরাসরি সুদ খায়, আর ইসলামী ব্যাংক সেই একই সুদ ঘুরিয়ে খায়। তাদের মতে এ দু’ধরনের ব্যাংকের মাঝে বাস্তবে কোন পার্থক্য নেই।(ইসলামী ব্যাংকিং)

২. আরেক শ্রেণীর লোক আছেন, তারা ইসলামী ব্যাংকিং সম্পূর্ণ অবাস্তব মনে করেন না। তারা ব্যাংকব্যবস্থায় সুদের অবসান হলে খুশি। কিন্তু তারা বুঝতে পারেন না এটা কিভাবে সম্ভব।

এ শ্রেণীর লোকদের একটি অংশ সুদভিত্তিক ব্যাংকের সাথে লেনদেন করেন এবং তাদের মাথায়ও এটা কিছুতেই ঢুকতে চায় না যে, ইসলামী ব্যাংক আসলেই সুদ বর্জন করে শরীয়ার নীতির ভিত্তিতে তাদের লেনদেন চালাতে সমর্থ হচ্ছে ।

এ শ্রেণীর লোকেরা দূর থেকে ইসলামী ব্যাংকের নানা কার্যক্রম ও পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতে সমালোচনা করে থাকেন।

৩. আরেক দল লোক রয়েছেন, তারা ইসলামী ব্যাংকের দৃঢ় সমর্থক এবং ইসলামী ব্যাংকের পক্ষে তারা কথা বলেন। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক ঠিক কিভাবে সুদ বর্জন করে ইসলামী শরীয়ার নীতির ভিত্তিতে ব্যবসা চালায়, সে সম্পর্কে তাদের অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই।

এ ব্যাপারে কারো কারো ধারণা এতটা আবছা যে, তারা ইসলামী ব্যাংকিংকে যে ভাষায় ব্যাখ্যা করেন, তার সাথে বাস্তব চিত্রের মিল নেই। ভক্তদের মধ্যে আরেক দল আছেন, যারা মনে করেন, ইসলামী ব্যাংক তাদের সব কাজ-কারবার শরীয়ার নীতি অনুযায়ী পরিচালনার কথা ঘোষণা করেছে।(ইসলামী ব্যাংকিং)

ফলে এখন এ ব্যাপারে জানা ও মানার সব দায়-দায়িত্ব ইসলামী ব্যাংকেরই।

৪. ইসলামী ব্যাংকের সাথে নিয়মিত লেনদেন করছেন, এমন অনেকের কাছেও সুদী ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের মধ্যকার পার্থক্য স্পষ্ট নয়। ইসলামী ব্যাংকের জমাগ্রহণ ও বিনিয়োগনীতির অনেক বিষয়ে তাদের মনেও অনেক প্রশ্ন রয়েছে।

এভাবে ইসলামী ব্যাংক থেকে দূরে অবস্থানকারী এবং ইসলামী ব্যাংকের সাথে লেনদেনকারী অনেকেরই ইসলামী ব্যাংক সম্পর্কে ধারণার ঘাটতি রয়েছে।(ইসলামী ব্যাংকিং)

দেশের দীর্ঘ-প্রাচীন সুদভিত্তিক পরিবেশ, শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়ের অনুপস্থিতি এবং ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়ে আলোচনা ও প্রচারের অভাবের কারণে ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে অনেক বিভ্রান্তি এবং অভিযোগ ও সমালোচনা রয়েছে।

ইসলামে আস্থা ও বিশ্বাস পোষণকারীদের মাঝেও এ ক্ষেত্রে জ্ঞানগত ঘাটতি যথেষ্ট পরিমাণেই বিরাজ করছে। সবচে’ দুঃখজনক বিষয় হলো, দীর্ঘদিন ইসলামী ব্যাংকের সাথে বিভিন্ন ধরনের লেনদেনের পরও অনেকেরই ধারণাগত ঘাটতি দূর হয়নি।(ইসলামী ব্যাংকিং)

ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে অভিযোগ ও সমালোচনা

ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে সচরাচর যেসব অভিযোগ ও সমালোচনা শোনা যায় তার কয়েকটি হলো :

১. ইসলামী ব্যাংক সুদী ব্যাংকের মতোই পূর্বনির্ধারিত হারে তাদের জমাকারীদেরকে মুনাফা দেয়।

২. ইসলামী ব্যাংক তার ডিপোজিটরদেরকে সব সময় শুধু লাভই দেয়। কখনো লোকসানের ভাগিদার বানায় না। অথচ ব্যবসায়ে লাভ ও লোকসান দু’টিরই সম্ভাবনা থাকে।(ইসলামী ব্যাংকিং)

৩. বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক পূর্বনির্ধারিত হারে লাভ আদায় করে। ব্যবসায়ে লোকসান হলে ব্যাংক সে লোকসানের ভাগ নেয় না। এটা তো সুদের মতোই হলো।

৪. সুদের ব্যাংক যেভাবে শতকরা হারে সুদের হিসাব করে, ইসলামী ব্যাংকও সেভাবেই শতকরা পদ্ধতিতে লাভের হিসাব করে। তাহলে শুধু নামে ছাড়া আর পার্থক্য থাকলো কোথায়?

৫. ব্যবসায়িক কারবারে পণ্যের প্রকৃতিভেদে লাভের হার ভিন্ন হয়। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক সব ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে একই হারে লাভ নির্ধারণ করে । এটা শরীয়ার দৃষ্টিতে কতটুকু গ্রহণযোগ্য?

৬. কোন গ্রাহক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে ব্যাংক মেয়াদের অতিরিক্ত সময়ের জন্য পাওনার ওপর নির্দিষ্ট হারে ক্ষতিপূরণ ধার্য ও আদায় করে। ব্যবসায়ে লোকসানের কারণে গ্রাহক সর্বস্বান্ত হলেও ব্যাংক তার অবস্থা বিবেচনা করে না। সুদী ব্যাংকের সাথে ইসলামী ব্যাংকের এ আচরণের পার্থক্য কোথায়?

৭. সুদী ব্যাংক তার ঋণের বিপরীতে বন্ধকী জামানত গ্রহণ করে। ইসলামী ব্যাংকও তাই করে । বন্ধকী জামানতের ব্যবস্থা করতে না পারলে ইসলামী ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ পাওয়া যায় না(ইসলামী ব্যাংকিং)।

এভাবে ইসলামী ব্যাংক শুধু ধনী ও সম্পদশালী লোকদেরকেই বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান করে। ধনীকে আরো ধনী বানায় । ইসলামী ব্যাংকের এ নীতি ইসলামী অর্থনীতির সাথে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ?

৮. ইসলামী ব্যাংক সুদভিত্তিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থেকে সুদী পরিবেশে কাজ করছে। এ নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ম-নীতির অধীনে কাজ করতে গিয়ে আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে ইসলামী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তার বিধিবদ্ধ তারল্য সঞ্চিতির অর্থ জমা রাখতে বাধ্য।(ইসলামী ব্যাংকিং)

এ ছাড়াও ইসলামী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা নিকাশ হিসাব’ রাখাসহ বিভিন্ন ধরনের আর্থিক লেনদেন করে থাকে। এ অবস্থায় ইসলামী ব্যাংক কিভাবে নিজেকে পুরোপুরি ‘সুদমুক্ত’ দাবি করতে পারে?

৯. ইসলামী ব্যাংক দেশের বিভিন্ন সুদী ব্যাংকের সাথে লেনদেন করতে বাধ্য হয় । এ ক্ষেত্রেও তার কার্যক্রম সুদের সাথে যুক্ত হয়।

১০. আমদানি-রফতানিসহ বিভিন্ন ধরনের বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনার জন্য ইসলামী ব্যাংক দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের সুদভিত্তিক ব্যাংকের সাথে হিসাব খুলে আর্থিক লেনদেন করতে বাধ্য হয়। এ অবস্থায় ইসলামী ব্যাংক সুদের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। তারপরও ইসলামী ব্যাংক সুদমুক্ত বলে কিভাবে দাবি করতে পারে?

এ ধরনের বহু প্রশ্ন ও অভিযোগ ইসলামী ব্যাংক সম্পর্কে রয়েছে।(ইসলামী ব্যাংকিং)

ইসলামী ব্যাংক সম্পর্কিত অভিযোগ খণ্ডন

ইসলামী ব্যাংক সম্পর্কে সর্বাধিক প্রচলিত এসব অভিযোগ ও সমালোচনা এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :

ইসলামী ব্যাংক জমাকারীদের যে মুনাফা দেয় তা কতটুকু বৈধ?

কিছু লোকের ধারণা, সুদী ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে যেমন পূর্ব নির্ধারিত হারে সুদ দেয়া হয়, ইসলামী ব্যাংকও অনুরূপ পূর্ব নির্ধারিত হারে মুনাফা দেয়। এছাড়া ইসলামী ব্যাংক তার জমাকারীদের সব সময় শুধু লাভই দেয়, লোকসানে শরীক করে না।(ইসলামী ব্যাংকিং)

ইসলামী ব্যাংকের লাভ সুদী ব্যাংকের সুদ থেকে কিভাবে পৃথক, তা স্পষ্ট নয়। এছাড়া ইসলামী ব্যাংক বিভিন্ন সুদভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সাথে লেনদেন করে। এ অবস্থায় ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত লাভ কতটা শরীয়াহসম্মত?

ইসলামী ব্যাংকিং: সমালোচনা ও বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক ও সুদী ব্যাংকের জমানীতির পার্থক্য

ইসলামী ব্যাংক সঞ্চয়ী ও মেয়াদী জমাকারীদের কাছ থেকে মুদারাবা পদ্ধতিতে টাকা জমা নেয়। ‘মুদারাবা’ এমন এক ব্যবসা পদ্ধতি যেখানে একপক্ষ মূলধন প্রদান করে।(ইসলামী ব্যাংকিং)

অন্যপক্ষ তার শ্রম, মেধা ও দক্ষতা নিয়োজিত করে সে মূলধন দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে। ব্যাংকিং লেনদেনের ক্ষেত্রে জমাকারী হলেন ‘সাহিবুল মাল’ (মূলধনদাতা), আর ব্যাংক এ ক্ষেত্রে ‘মুদারিব’ বা ব্যবসা পরিচালনাকারী।

ইসলামী ব্যাংক তার জমাকারীদের তহবিল শরীয়াহ অনুমোদিত বিভিন্ন পন্থায় বিনিয়োগ করে। ব্যবসায় লাভ হলে চুক্তি অনুযায়ী আনুপাতিক হারে উভয়ের মধ্যে তা ভাগ হয়। লোকসান হলে তা মূলধনদাতা বহন করেন।

ইসলামী ব্যাংক জমাকারীদের কাছ থেকে ইসলামী শরীয়ার ‘আল ওয়াদিয়া’ নীতির ভিত্তিতে চলতি হিসাবে এবং ‘মুদারাবা’ নীতির ভিত্তিতে সঞ্চয়ী, মেয়াদী ইত্যাদি লাভ-লোকসান অংশীদারি হিসেবে টাকা জমা নেয়। অন্যদিকে সুদী ব্যাংক পূর্বনির্ধারিত সুদের হারের ভিত্তিতে তাদের সঞ্চয়ী ও ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্টে টাকা জমা নেয়।

ইসলামী ব্যাংকের জমা গ্রহণের নীতি ও পদ্ধতি সুদী ব্যাংকের হিসাব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। সুদী ব্যাংক পূর্ব নির্ধারিত সুদের হারের ভিত্তিতে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা জমা নেয় এবং সে টাকা তারা সম্পূর্ণ সুদের ভিত্তিতে হালাল-হারাম নির্বিশেষে যেকোন খাতে খাটিয়ে অর্থ আয় করে।

এ ক্ষেত্রে তারা জমাকারীদের কাছ থেকে কম দামে টাকা কিনে ঋণগ্রহীতাদের কাছে সে টাকা বেশি দামে বিক্রি করে। টাকা কেনাবেচার এ সুদী কারবার থেকে প্রাপ্ত আয় সম্পূর্ণ হারাম। এ হারাম টাকার একটি অংশ‍ই তারা জমাকারীদের দিয়ে থাকে।(ইসলামী ব্যাংকিং)

পক্ষান্তরে ইসলামী ব্যাংক শরীয়াহ অনুমোদিত পদ্ধতিতে জমা গ্রহণ করে সে অর্থ কেবল শরীয়াহ অনুমোদিত হালাল পন্থায় হালাল খাতে বিনিয়োগ করে থাকে।

ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগপদ্ধতির মধ্যে রয়েছে বাই-মুরাবাহা, বাই-মুয়াজ্জাল, বাই-সালাম, ইসতিসনা, মুশারাকা, মুদারাবা ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে জমাকারীগণ ব্যবসায়ে লাভের ভাগীদার হন। সুদী ব্যাংকের মতো পূর্বনির্ধারিত হারে সুদ পান না।(ইসলামী ব্যাংকিং)

পূর্বনির্ধারিত সুদ বনাম প্রাক্কলিত লাভ

ব্যাংকের হিসাব চূড়ান্ত হওয়ার আগেই ‘সাহিবুল মাল’ বছরের যেকোন সময় তার মূলধন প্রত্যাহার করতে পারেন। তাই লাভ-লোকসান হিসাব করার জন্য বছরের শেষ দিন পর্যন্ত গ্রাহককে আটকে না রেখে বিগত বছরের লাভের আলোকে একটা প্রাক্কলিত বা আনুমানিক লাভ (Provisional profit) গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে দিয়ে দেয়া হয়।

বছরের শেষে হিসাব চূড়ান্ত হওয়ার পর গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে লাভের বাকি অংশ (যদি থাকে) দেয়া হয়। প্রাক্কলিত লাভের চেয়ে প্রকৃত লাভ কম হলে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে তা কেটে নেয়া হয়।

ব্যবসায়ের চূড়ান্ত ফলাফল অনুযায়ী ব্যবসায়ে লোকসান হলে মুদারাবা ব্যবসায়ের নিয়মানুযায়ী তা ‘সাহিবুল মাল’ বা অ্যাকাউন্টহোল্ডারকে বহন করতে হয়। এভাবেই সুদী ব্যাংকের সাথে ইসলামী ব্যাংকের সঞ্চয়ী ও বিভিন্ন মেয়াদী জমা হিসাবসমূহের পদ্ধতিগত মৌলিক পার্থক্য সৃষ্টি হয়।(ইসলামী ব্যাংকিং)

ইসলামী ব্যাংক জমাকারীদের সব সময় লাভ দেয় কিভাবে?

ইসলামী ব্যাংকের ব্যবসায়ে কোথাও কোথাও লোকসানও হতে পারে। তবে ইসলামী ব্যাংক বহু-বিচিত্র খাতে লাখ লাখ গ্রাহককে বিনিয়োগ করে থাকে। তার মধ্যে কিছু ব্যবসায়ে লোকসান এবং বাকি সব ব্যবসায়ে লাভ হলে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকের ব্যবসায়ের ফলাফল দাঁড়ায় লাভ।

এটিই বিগত বছরগুলোতে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ কার্যক্রমের বাস্তব অভিজ্ঞতা। ফলে বিগত বছরগুলোতে কখনো গ্রাহককে লোকসান বহন করতে হয়নি । আর ব্যবসায় লোকসান না হলে সে ব্যবসা হালাল হবে না, এ ধারণা শরীয়াসম্মত নয়।(ইসলামী ব্যাংকিং)

এ ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় হলো, কোন বছর লাভ কম হলে চুক্তি অনুযায়ী জমাকারীকে (সাহিবুল মালকে) তার প্রাপ্য লাভ দিয়ে দেয়ার পর ব্যাংক তার নিজস্ব লাভ থেকেও কিছু অংশ ছেড়ে দিতে পারে।

এভাবে নিজের লাভের কিছু অংশ স্বেচ্ছায় অন্যকে ছেড়ে দেয়া পুরোপুরি বৈধ। ইসলামী শরীয়াহ্ একে উৎসাহিত করা হয়েছে। এটাকে শরীয়ার পরিভাষায় ‘ইহসান’ বলা হয় । ইসলামী ব্যাংক সাহিবুল মালকে লাভ দেয়ার ক্ষেত্রে ইহসানের নীতি অনুসরণ করে থাকে।

ইসলামী ব্যাংকের জন্য আরেকটি বিবেচ্য বিষয় হলো, ব্যবসায়ে লোকসানের কারণে জমাকারীর মূলধন খোয়া গেলে ব্যাংকের আমানতের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এ বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রাখা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের জন্য জরুরি। এ কারণে আকস্মিক লোকসানের হাত থেকে গ্রাহকের মূলধনকে রক্ষা করার জন্য ইসলামী ব্যাংক সচেষ্ট রয়েছে।

এ উদ্দেশ্যে ‘বিনিয়োগ ক্ষতিপূরণ সঞ্চিতি তহবিল’ বা Investment Loss Offsetting Reserve (ILOR) নামে ইসলামী ব্যাংকের একটি বিশেষ তহবিল রয়েছে। ব্যাংক প্রতিবছর তার নিজস্ব আয়ের একটি অংশ এ রিজার্ভ ফান্ডে জমা রাখে।(ইসলামী ব্যাংকিং)

প্রয়োজন দেখা দিলে উক্ত সংরক্ষিত নিজস্ব তহবিল থেকে গ্রাহকের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া সম্ভব। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর একটি বড় রিজার্ভ ফান্ড গত একুশ বছরে গড়ে উঠেছে।

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় কোন সমস্যায় না পড়ায় তাকে কখনো এ তহবিলে হাত দিতে হয়নি। এটি ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে সমালোচনার বিষয় হতে পারে না। তাদের পরিচালনগত দক্ষতা ও উন্নত তহবিল ব্যবস্থাপনা এ কারণে প্রশংসার দাবিদার।(ইসলামী ব্যাংকিং)

সন্দেহজনক আয় কি করা হয়?

ইসলামী ব্যাংক কোন্ পদ্ধতিতে কত টাকা বিনিয়োগ করছে, তাতে শরীয়ার নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে কি না, ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতির (বাই-মুরাবাহা, বাই-মুয়াজ্জাল, বাই-সালাম ইত্যাদি) মাধ্যমে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শরীয়ার নীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হয়েছে কি না, তা নিয়মিতভাবে ব্যাংকের শরীয়াহ কাউন্সিলের পক্ষ থেকে শাখা পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।

কোন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম ধরা পড়লে তা থেকে প্রাপ্ত আয়কে শরীয়ার দৃষ্টিতে সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ অর্থ ব্যাংকের স্বাভাবিক আয় থেকে পৃথক করে শরীয়াহ্ কাউন্সিলের রায় অনুযায়ী শরীয়াহ্ অনুমোদিত ভিন্ন কোন কাজে ব্যয় বা ব্যবহার করা হয়। সন্দেহজনক বা অবৈধ আয় জমাকারীদের মধ্যে বণ্টন করা হয় না।

ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ কার্যক্রম কতটা ইসলামী?

ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ সম্পর্কে সমালোচকগণ বলে থাকেন যে, ইসলামী ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ নিলে সুদী ব্যাংকের মতই পূর্বনির্ধারিত হারে মুনাফা দিতে হয়।

সুদী ব্যাংকে যেরূপ সুদের হার নির্ধারিত থাকে, ইসলামী ব্যাংকেও সেভাবে আগেই মুনাফার হার নির্ধারিত করে দেয়া হয়। ব্যবসায়ে লোকসান হলে ব্যাংক তার ভাগ নেয় না। তারা শুধু লাভের বেলায় আছে, লোকসানে নেই ।

ইসলামী ব্যাংক শতকরা হারে তাদের লাভের হিসাব করে। মেয়াদোত্তীর্ণ পাওনার ওপর ক্ষতিপূরণ ধার্য করে। বিনিয়োগ আদায় নিশ্চিত করার জন্য সম্পত্তি বন্ধক নেয় । ইসলামী ব্যাংকের হিসাব-পত্র ও নিয়ম-কানুনের সাথে সুদী ব্যাংকের পার্থক্য বুঝা যায় না।(ইসলামী ব্যাংকিং)

পূর্বনির্ধারিত হারে লাভ আদায় কি বৈধ ?

প্রথমেই বিবেচ্য হলো, লাভ পূর্বনির্ধারিত হলেই তা সুদের পর্যায়ে পড়বে কি- না। ইসলামী শরীয়ায় লাভ-লোকসান অংশীদারী পদ্ধতিতে ব্যবসা করার যেমনি অনুমতি আছে, অনুরূপ মূলধনের ওপর পূর্ব নির্ধারিত লাভ করারও শরীয়াসম্মত হালাল ব্যবসা-পদ্ধতি আছে।

বাই মুরাবাহা, বাই মুয়াজ্জাল, বাই সালাম প্রভৃতি পদ্ধতি বেচাকেনার সাথে যুক্ত। এ ধরনের বেচাকেনা বাজারে প্রতিনিয়ত চলছে এবং শরীয়াহ্ তা অনুমোদন করে। যেমন মাল কিনে ক্রয়মূল্যের সাথে নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভ যোগ করে তা পুনরায় বিক্রি করাকে ‘বাই-মুরাবাহা’ বলে।(ইসলামী ব্যাংকিং)

ইসলামী ব্যাংক তার গ্রাহকদের অনুরোধে কোন মাল সংগ্রহ করে তার কাছে ‘মুরাবাহা’ পদ্ধতিতে বিক্রি করে। ইসলামী ব্যাংকের এ ধরনের মুরাবাহাকে “মুরাবাহা লিল্ আমির বিশিরা’ বলা হয়।`

এ পদ্ধতিতে ব্যাংক প্রথমে গ্রাহকের কাছ থেকে মালের অর্ডার নেয়। সে অনুযায়ী বাজার থেকে নগদমূল্যে মাল খরিদ করে। ব্যাংক তার ক্রয়মূল্যের সাথে নির্দিষ্ট লাভ যোগ করে গ্রাহকদের কাছে তা বিক্রি করে ।

মুরাবাহা পদ্ধতির বেচাকেনায় লাভ অবশ্যই পূর্ব নির্ধারিত হতে হবে। লাভ নির্ধারিত না করে লেনদেন করলে মুরাবাহা বেচাকেনা শুদ্ধ হবে না। বাজারে-দোকানে প্রতিদিন সকলেই এ ধরনের অসংখ্য লেনদেন করছেন। আল-কুরআনে এ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল বলা হয়েছে এবং সুদের সাথে এটির সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করা হয়েছে।(ইসলামী ব্যাংকিং)

সুদী ব্যাংকের ঋণ প্রদানপদ্ধতির সাথে ইসলামী ব্যাংকের এ বিনিয়োগপদ্ধতি সম্পূর্ণ পৃথক। ধরা যাক, সুদভিত্তিক ব্যাংক কাউকে এক লাখ টাকা ঋণ দিয়ে এক বছরের জন্য পনেরো হাজার টাকা সুদ ধার্য করে দিলো।(ইসলামী ব্যাংকিং)

অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংক এক লাখ টাকায় কোন মাল কিনে তা এক লাখ পনেরো হাজার টাকায় বিক্রি করে টাকা পরিশোধের জন্য এক বছর সময় দিলো। এক্ষেত্রে টাকা আদায়ের মেয়াদ, হিসাব ও লাভ আপাত দৃষ্টিতে একই রকম মনে হয়।

কিন্তু প্রথমটি টাকার ঋণের বিপরীতে ধার্যকৃত সুদ। দ্বিতীয়টি পণ্যের ক্রয়- বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্জিত হালাল মুনাফা। প্রথমটি সুদী পদ্ধতিতে টাকার লেনদেন। দ্বিতীয়টি হলো পণ্যের ব্যবসা।(ইসলামী ব্যাংকিং)

প্রথম পদ্ধতিকে ইসলামী শরীয়াহ্ সুস্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করেছে, আর দ্বিতীয় পদ্ধতিকে সম্পূর্ণরূপে বৈধ বা হালাল বলেছে।

সুদকে আল্লাহ তা’আলা হারাম ঘোষণা করেছেন। অতএব, সুদ অবশ্যই বর্জন করতে হবে। এমনকি সুদের আশংকা সৃষ্টিকারী কোন লেনদেন করাও সঙ্গত নয় । এ প্রসঙ্গে আবূ সাঈদ আল্ খুদরী (রা) ও আবূ হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।(ইসলামী ব্যাংকিং)

রাসূলুল্লাহ (3) একজন সাহাবীকে খাইবারে কর্মচারী নিয়োগ করেন। ঐ সাহাবী রাসূল ($)-এর নিকট ভাল মানের কিছু খেজুর নিয়ে এলেন। রাসূল (:) জানতে চাইলেন, খাইবারের সব খেজুর কি এ রকম? তিনি বললেন, না, আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রাসূল!

আমরা এ মানের এক সা’ খেজুর সংগ্রহ করি সাধারণ মানের দুই সা’ খেজুরের বিনিময়ে। দুই সা’ সংগ্রহ করি তিন সা’-এর বিনিময়ে। রাসূল (3) বললেন, ‘এ রকম করো না। প্রথমে তোমাদের খেজুর দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করবে। এরপর উক্ত দিরহাম দিয়ে উন্নত মানের খেজুর কিনবে।

এখানে এ দুই লেনদেনের মধ্যে কেউ কেউ কোন তফাত খুঁজে পাবেন না। এটিকেও কারো কাছে ঘুরিয়ে খাওয়া মনে হতে পারে। কিন্তু রাসূল () প্রথমটি নিষিদ্ধ করেছেন এবং দ্বিতীয় পদ্ধতিটি অনুমোদন করেছেন ।

সমজাতীয় বস্তু কমবেশি করে কেনাবেচাতে কোন এক পক্ষের প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ইসলামী ব্যাংক সুদের আশঙ্কাযুক্ত সকল পদ্ধতি পরিহার করে সুদমুক্ত পদ্ধতি ও পন্থা অবলম্বন করে, এটিই শরীয়াহ অনুমোদিত সঠিক কর্মনীতি।(ইসলামী ব্যাংকিং)

ক্রয়-বিক্রয় ছাড়াও নানা প্রয়োজনে বাড়ি, যন্ত্রপাতি, যানবাহন বা অন্যকোন সম্পদ পূর্বনির্ধারিত হারেই ভাড়া দেয়া হয়। মূল্য বা ভাড়া পূর্ব নির্ধারিত হওয়ার সাথে সুদের সম্পর্ক নেই। সুদ ও লাভের মধ্যে পার্থক্যের কারণ সম্পূর্ণ আলাদা।

ইসলামী ব্যাংক কি শুধু লাভে আছে, লোকসানে নেই?

ইসলামী ব্যাংক শরীয়াহ্ভিত্তিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। ইসলামের বিধান অনুসরণ করে ব্যবসা পরিচালনা করতে এ ব্যাংক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শরীয়ায় যেসব পদ্ধতিতে ব্যবসা করা বৈধ, তা প্রধানত তিন প্রকার। যথা : ১. ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি, ২. অর্থায়ন পদ্ধতি এবং ৩. ইজারা পদ্ধতি।(ইসলামী ব্যাংকিং)

এ তিনটি পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্রয়-বিক্রয় বা ‘বাই’ পদ্ধতি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন :

‘আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। ক্রয়-বিক্রয়পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য হলো, বিক্রিত মাল ক্রেতাকে বুঝিয়ে দেয়ার পর তা নষ্ট হয়ে গেলে বা হারিয়ে গেলে বা ক্রেতা তা অন্যত্র কম দামে বিক্রি করার কারণে তার লোকসান হলে বিক্রেতা সে ক্ষতি বা লোকসান বহন করেন না।

ক্রয়-বিক্রয়পদ্ধতি অর্থাৎ বাই-মুরাবাহা বা বাই-মুয়াজ্জাল পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংক ও গ্রাহকের মধ্যকার সম্পর্ক হচ্ছে বিক্রেতা-ক্রেতা সম্পর্ক। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক বিক্রেতা আর গ্রাহক ক্রেতা।(ইসলামী ব্যাংকিং)

ব্যাংক বাজার থেকে মাল কিনে তা গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে এবং মূল্য পরিশোধের জন্য নির্ধারিত সময় দেয়। এ মালে গ্রাহকের লাভ-লোকসানের সাথে ব্যাংকের সম্পর্ক নেই । গ্রাহক সে পণ্যের ব্যবসায়ে পূর্ব ধারণার তুলনায় বেশি লাভ করলে সে বাড়তি লাভের সাথেও ব্যাংকের কোন সম্পর্ক থাকে না।

অন্যদিকে মুদারাবা ও মুশারাকা পদ্ধতির ব্যবসায়ে পূর্বনির্ধারিত হারে লাভ করার কোন সুযোগ নেই । মুশারাকার ক্ষেত্রে লাভ হলে তা চুক্তির শর্ত অনুসারে বণ্টন হবে। লোকসান হলে তা মূলধনের আনুপাতিক হারে ব্যাংক ও গ্রাহক বহন করবে।(ইসলামী ব্যাংকিং)

মুদারাবা ব্যবসায়েও লাভ দু’পক্ষের মধ্যকার চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বণ্টিত হবে। আর লোকসান হলে ব্যাংক ‘সাহিবুল মাল’ হিসেবে তা একাই বহন করবে। সুতরাং ইসলামী ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ নিলে পূর্ব নির্ধারিত হারে মুনাফা দিতে হয়, আর এ কারণে ইসলামী ব্যাংকের লেনদেন ইসলামী শরীয়াহ্সম্মত নয়, এ ধরনের অনুমানভিত্তিক ধারণা করার সুযোগ নেই।

ইসলামী লেনদেনের বৈধ পদ্ধতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না নিয়ে ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে সুদ খাওয়ার অভিযোগ তোলা দুর্ভাগ্যজনক এবং শরীয়ার দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য।(ইসলামী ব্যাংকিং)

আরেকটি পদ্ধতি হলো ‘হায়ার পার্চেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক’ বা মালিকানায় শরীকানার ভিত্তিতে ভাড়ায় ক্রয়। এ পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যাংক মেশিন, যন্ত্রপাতি, যানবাহন, স্থায়ী সম্পদ ইত্যাদি গ্রাহকের নিকট ভাড়া দেয় এবং তা কিস্তিতে বিক্রি করার চুক্তি করে । এরূপ ভাড়া (ইজারা) চুক্তির বেলাতেও ব্যাংক লোকসান বহন করতে বাধ্য নয়।

মুশারাকা বিনিয়োগে লোকসান ভাগ হয় মূলধনের আনুপাতিক হারে

অংশীদারী বা মুশারাকা ব্যবসাপদ্ধতি ক্রয়-বিক্রয়পদ্ধতির মতো নয় ৷ এ ক্ষেত্রে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অংশীদারীর ভিত্তিতে মূলধনের যোগান দেয়। ব্যবসায় লাভ হলে তা চুক্তি অনুযায়ী বণ্টন হয়।

লোকসান হলে পুঁজির আনুপাতিক হারে সকলকে সে লোকসান বহন করতে হয়। মুশারাকা পদ্ধতিতে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক মূলধনের একাংশ যোগান দেয় এবং গ্রাহক বাকী অংশ দেয়।

ব্যবসায় লাভ হলে তাতে ব্যাংক ও গ্রাহক চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ভাগ পাবে, আর লোকসান হলে উভয় পক্ষ তাদের মূলধনের অনুপাত অনুযায়ী লোকসান বহন করবে। এটাই মুশারাকা পদ্ধতির সারকথা।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠা লাভের পর পরই মুশারাকা পদ্ধতিতে ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু দেশের আইন কাঠামো ও অন্যান্য বাস্তব পরিস্থিতির কারণে এ ব্যাংক মুশারাকা পদ্ধতির অনুশীলন করতে গিয়ে কিছু বাস্তব অসুবিধার সম্মুখীন হয়।(ইসলামী ব্যাংকিং)

ফলে এ পদ্ধতির বিনিয়োগে ভাটা পড়ে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড মুশারাকা পদ্ধতিতে তার বিনিয়োগ বাড়ানোর ব্যাপারে এখন আবার উদ্যোগ নিয়েছে।

এ ব্যাপারে ম্যানুয়েল প্রণয়ন করা হয়েছে এবং বছরওয়ারি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়নের ব্যাপারে চেষ্টা চলছে। ভালো গ্রাহকদের সহযোগিতা পেলে ব্যাংক এ কার্যক্রমে সফল হবে বলে আশা করা যায়।

মুদারাবা বিনিয়োগে ব্যাংক একাই লোকসান বহন করে

মুদারাবা পদ্ধতিতে ব্যাংক ‘সাহিবুল মাল’ এবং গ্রাহক ‘মুদারিব’ হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। কোন গ্রাহক বিনিয়োগ গ্রহণ করার পর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় লাভ হলে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সে লাভ গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে ভাগ হবে।

কিন্তু লোকসান হলে তার পুরোটাই ‘সাহিবুল মাল’ হিসেবে ইসলামী ব্যাংক একা বহন করবে। এ পদ্ধতিতে ব্যবসা করার জন্য উন্নত নৈতিকতা, আমানতদারী ও সততাসম্পন্ন গ্রাহকের প্রয়োজন।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের ঋণখেলাপী পরিবেশে ইসলামী ব্যাংকারগণ মুদারাবা পদ্ধতিতে বিনিয়োগের ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ পান না।(ইসলামী ব্যাংকিং)

তারপরও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ইসলামী ব্যাংকিং-এর বুনিয়াদি লক্ষ্য হাসিল এবং এ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যকে সমুন্নত করার তাকীদ থেকে মুশারাকার পাশাপাশি মুদারাবা বিনিয়োগ পরিচালনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এ উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র ম্যানুয়েল প্রণয়ন করেছে।

শতকরা হারে লাভ ধার্য প্রসঙ্গে

দীর্ঘদিন থেকে চালু থাকা সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থায় সুদের হিসাব শতকরা হার অনুযায়ী করা হয়। অনেকে ছাত্রাবস্থায় ঐকিক নিয়মে শতকরা হারে সুদের হিসাব করেছেন।

এ মনস্তাত্ত্বিক পটভূমিতে তাদের কাছে শতকরা হারের হিসাব সুদের সমার্থক বলে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে শতকরা হার একটি হিসাব পদ্ধতি মাত্র। এ পদ্ধতিতে ভালো-মন্দ, হালাল-হারাম, লাভ-লোকসান সব ধরনের হিসাবই করা সম্ভব।

হালাল ব্যবসা-বাণিজ্যের লাভ-লোকসান বা আয়-ব্যয়ের হিসাব শতকরা পদ্ধতিতে করা শরীয়ার দৃষ্টিতে আপত্তিকর নয়। এ ধরনের স্বাভাবিক হিসাব-রীতি পুরোপুরি শরীয়াহ্সম্মত।(ইসলামী ব্যাংকিং)

সকল পণ্যে একই হারে লাভ নির্ধারণ কি বৈধ?

ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ সম্পর্কে আরেকটি অভিযোগ হলো, ব্যবসায়ীগণ তাদের কেনাবেচার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পণ্যে বিভিন্ন ক্রেতার কাছ থেকে বিভিন্ন রকম লাভ করেন।

অথচ ইসলামী ব্যাংক সকল পণ্যের জন্য সকল ক্রেতার ওপর একই হারে লাভ ধার্য করে। চাল, ডাল, আলু, রড, সিমেন্ট, সার, কয়লা, কাপড় তথা সকল পণ্যে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেই লাভের হার প্রায় এক রকম। ইসলামী ব্যাংক সত্যিকার অর্থে ব্যবসা করলে তার সাথে ব্যবসায়ীদের লাভের হারের মিল নেই কেন?

ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে এরূপ অভিযোগ উত্থাপন করার আগে দেখতে হবে লাভ নির্ধারণের ক্ষেত্রে শরীয়ার নীতি কীরূপ।

বিভিন্ন পণ্যে ভিন্ন ভিন্ন হারে লাভ করা জরুরি কি না, কিংবা কোন্ পণ্যে কত লাভ করতে হবে এমন কোন কথা কুরআন-হাদীসে রয়েছে কি না। এক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য হলো, ইসলামী ব্যাংক লাভ নির্ধারণের ক্ষেত্রে শরীয়ার কোন নির্দেশ বা নীতিকে লঙ্ঘন করছে কি না।

এ প্রসঙ্গে উরওয়া ইবনে আবিল জাদ আল বারেকী (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করা যেতে পারে। মহানবী ()-এর নিকট পশুর একটি চালানের খবর এল।

তিনি উরওয়া (রা)-কে একটি দিনার দিয়ে একটি বকরী কিনে আনতে পাঠালেন। উরওয়া (রা) এক দিনার দিয়ে দু’টি বকরী কিনলেন । পথে অন্য এক লোকের কাছে এক দিনারের বিনিময়ে একটি বকরী বিক্রি করে দিলেন।

বাকি একটি বকরী ও এক দিনার নিয়ে ফিরে এসে তিনি রাসূল ()- কে দিলেন। পুরো বিষয়টি শোনার পর রাসূল () আল্লাহর কাছে উরওয়ার লেনদেনে বরকত কামনা করে দোয়া করলেন ।”

এ হাদীস থেকে দেখা যাচ্ছে শতকরা একশ’ ভাগ লাভ করার পরও হযরত উরওয়ার ব্যবসায়ে বরকতের জন্য রাসূল (3) দু’আ করেছেন। মজুতদারী না করে, প্রতারণার আশ্রয় না নিয়ে বা কারো ওপর যুলুম না করে ক্রেতার স্বাভাবিক ও স্বেচ্ছা-সম্মতির ভিত্তিতে কোন পণ্য বিক্রি করে বিক্রেতা বেশি লাভ করলে শরীয়ায় তা বৈধ।

লাভের সর্বনিম্ন সীমা সম্পর্কে তিরমিযী শরীফের একটি হাদীস থেকে ধারণা পাওয়া যায় । আমর ইবনে শুআইব তাঁর পিতা থেকে দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূল () বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোন ইয়াতীমের অভিভাবকত্ব লাভ করে, সে যেন উক্ত ইয়াতীমের সম্পদ থাকলে তা ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করে, যাতে যাকাত তা খেয়ে না ফেলে ।” এখানে মূলধন সংরক্ষণের তাকীদ লক্ষ্য করা যায়।

কোন্ পণ্যে কত লাভ করা যাবে, সর্বকালীন ও বিশ্বজনীন আদর্শ ইসলামে এরূপ স্থায়ী নির্দেশনা না থাকাই স্বাভাবিক। তবে শরীয়ার সাধারণ নীতির আলোকে কোন কোন ইসলামী চিন্তাবিদ পণ্যের ধরন অনুযায়ী লাভ নির্ধারণের কিছু নীতিমালা উল্লেখ করেছেন । যেমন:

ক. যেসব পণ্য একই বছর বারবার উৎপাদিত হয়, সেগুলোতে কম লাভ করা এবং যেসব পণ্য বিলম্বে উৎপাদিত হয়, সেগুলোতে বেশি লাভ করা;

খ. নগদ বিক্রির বেলায় কম লাভ করা এবং বাকিতে বিক্রির বেলায় বেশি লাভ করা;

গ. অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ক্ষেত্রে কম লাভ করা, আর বিলাসদ্রব্যের ক্ষেত্রে বেশি লাভ করা।(ইসলামী ব্যাংকিং)

ইসলামী ব্যাংক একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নানা বিষয় বিবেচনা করে বিনিয়োজিত মূলধনের লাভের হার নির্ধারণ করে থাকে। ব্যাংকের জন্য নিরাপদ ও সহজ পদ্ধতি হলো বাকিতে বিক্রয়কে বিবেচনায় রেখে লাভ নির্ধারণ করা।

নগদ বিক্রি করলে যে লাভ হয়, বাকিতে বিক্রির ক্ষেত্রে তারচেয়ে বেশি লাভ করা শরীয়ায় বৈধ। ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই ইমাম আবূ হানিফা, ইমাম শাফিঈ, ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদ (র) শরীয়ার বিভিন্ন দলিল পর্যালোচনা করে লাভ নির্ধারণের এ পদ্ধতি বৈধ বলে মত প্রকাশ করে গেছেন।

এছাড়া কী পরিমাণ লাভ করলে মুদারাবা জমাকারীদেরকে কাঙ্ক্ষিত লাভ দেয়া যাবে, শেয়ারহোল্ডারদেরকে কাঙ্ক্ষিত ডিভিডেন্ড দেয়া যাবে এবং ব্যাংকিং সেক্টরে ইসলামী ব্যাংক একটি মর্যাদাপূর্ণ লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সকলের আস্থা অর্জন ও তার সুনাম ধরে রাখতে এবং সাফল্যের সাথে তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারবে, সেসব দিক সামনে রেখে ইসলামী ব্যাংক তার বিনিয়োগের বিপরীতে লাভের হার বিবেচনা করে থাকে।

যে সকল পণ্য মানুষের জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ও নিত্যপ্রয়োজনীয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে লাভ তুলনামূলকভাবে কম করা ইসলামী আর্থিক নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

এছাড়া সমাজের সুবিধাবঞ্চিত লোকদেরকে বিনিয়োগসুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রেও তুলনামূলকভাবে কম লাভ করার বিষয়টি বিশেষ বিবেচনা পেতে পারে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড তার পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় গ্রামের দরিদ্র লোকদেরকে বন্ধকী জামানত ছাড়াই ৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগসুবিধা দিয়ে থাকে।

তাদের ক্ষেত্রে লাভের হারও কম ধার্য করা হয়। অনুরূপভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য ইসলামী ব্যাংকের বিশেষ স্কীম রয়েছে। সেখানেও কম হারে লাভ করা হয়। এটি কল্যাণমুখী অর্থব্যবস্থা প্রবর্তনে ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য ও কর্মনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।(ইসলামী ব্যাংকিং)

খেলাপী গ্রাহকের ওপর ক্ষতিপূরণ আরোপ করা কি শরীয়াসম্মত ?

আরেকটি অভিযোগ হলো, কোন গ্রাহক নির্ধারিত সময়ে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে ইসলামী ব্যাংক মেয়াদের অতিরিক্ত সময়ের জন্য পাওনা টাকার ওপর নির্দিষ্ট হারে ক্ষতিপূরণ আরোপ করে।

সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের ব্যবসায়ে লোকসান হলে কিংবা গ্রাহক সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেও ব্যাংক তা বিবেচনা করে না। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত সুদী ব্যাংকের সাথে তাদের আচরণ ও পদ্ধতির তেমন কোন পার্থক্য নেই।(ইসলামী ব্যাংকিং)

অথচ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এ প্রসঙ্গে বলেন, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি অসচ্ছল হয়ে পড়লে তাকে সচ্ছলতা আসা পর্যন্ত অবকাশ দাও, আর সাদকাহ করা (এরূপ অসচ্ছল ব্যক্তির ঋণ মাফ করে দেয়া) তোমাদের জন্য উত্তম।

দেনাদার ব্যক্তি অসচ্ছল হলে তাকে মাফ করা কুরআনের দৃষ্টিতে একটি উত্তম কাজ। তবে ব্যক্তিগতভাবে কাউকে টাকা ধার দিয়ে পাওনা টাকা মাফ করে দেয়া আর ব্যাংক কর্তৃক তার পাওনা মাফ করে দেয়া এককথা কি-না তা বিবেচনার দাবি রাখে।

ব্যাংক মুদারাবা পদ্ধতিতে সর্বস্তরের জমাকারীর কাছ থেকে মূলধন নিয়ে তা বিনিয়োগ করে। খেলাপী গ্রাহকের কাছে আটকে পড়া টাকার মালিক ব্যাংক নয়। জমাকারীগণ ইসলামী ব্যাংকে টাকা জমা করেন ব্যবসা থেকে হালাল উপায়ে লাভ পাওয়ার জন্য।(ইসলামী ব্যাংকিং)

সে টাকা মাফ করে দেয়ার শর্তে নয়। এ অবস্থায় কাউকে মাফ করার জন্য যথার্থ শারঈ কারণ থাকা দরকার এবং তার প্রয়োগ অত্যন্ত সীমিত পর্যায়ে হওয়াও বাঞ্ছনীয়।(ইসলামী ব্যাংকিং)

কোন গ্রাহক সঙ্গত কারণে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে যথার্থই অসমর্থ হয়ে পড়লে ইসলামী ব্যাংক তাকে সময় বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে দেখতে হবে, গ্রাহক আসলেই অসমর্থ হয়ে পড়েছেন কি না।

ব্যাংকের পাওনা পরিশোধকে কোন কোন গ্রাহক সর্বোচ্চ জরুরি বিষয় মনে করেন না। ঋণ পরিশোধে অনেক ক্ষেত্রে সদিচ্ছার ঘাটতি দেখা যায়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, ব্যাংকের ঋণ- খেলাপীদের মধ্যে দরিদ্র গ্রাহকের তুলনায় বিত্তবানদের সংখ্যাই বেশী।

এরূপ ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে অসমর্থ নন। কোন কোন গ্রাহক এক খাতে ব্যবসার কথা বলে বিনিয়োগ নিয়ে তা অন্য খাতে ব্যবহার করেন। ফলে সময়মতো ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে পারেন না।(ইসলামী ব্যাংকিং)

ওয়াদা ও বিশ্বাস ভঙ্গকারী এসব গ্রাহকের মূল সমস্যা টাকার নয়, স্বভাবের। রাসূলুল্লাহ ()-এর ভাষায় এরা যালিম। সচ্ছল ধনী ব্যক্তির টাল-বাহানা যুলুম। ঋণ পরিশোধে সক্ষম ব্যক্তির টাল- বাহানা করা তার সম্মানহানি ও শাস্তিকে হালাল বা বৈধ করে দেয়।

১০ অর্থাৎ সমর্থ ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করলে তা যুলুম হিসেবে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে অবকাশ দেয়ার পরিবর্তে তাকে শাস্তি দেয়া বৈধ হবে।

খেলাপী গ্রাহকদের কাছ থেকে দ্রুত টাকা আদায়ের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক অস্থায়ীভাবে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারে। এ অনুমতি শরীয়াহ্ বিশেষজ্ঞগণ দিয়েছেন। এটি খেলাপী গ্রাহকদের বিরুদ্ধে একটি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।

তবে এ ধরনের ক্ষতিপূরণ আরোপ করার এখতিয়ার ইসলামী ব্যাংকের হাতে না থেকে তৃতীয় কোন সংস্থার হাতে থাকা উচিত ।(ইসলামী ব্যাংকিং)

এ ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, জাতীয় পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় একজন আইনবিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক সমন্বয়ে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন কমিটি রয়েছে।

এ ব্যাপারে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হলো, ক্ষতিপূরণ হিসেবে আদায়কৃত অর্থ ব্যাংকের হালাল আয়রূপে গণ্য করা হয় না। শরীয়াহ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মুতাবেক শরীয়াহ্ অনুমোদিত পন্থায় তা জনহিতকর কাজে ব্যয় করা হয়।

বিনিয়োগ গ্রাহকদের সম্পত্তি বন্ধক নেয়া এবং ধনীদের আরো ধনী বানানোর অভিযোগ প্রসঙ্গে

অভিযোগ হলো, যাদের বন্ধক রাখার মতো সম্পদ নেই, তারা ইসলামী ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ পায় না। ইসলামী ব্যাংক কেবলমাত্র বিত্তবানদেরকে বিনিয়োগসুবিধা দেয় এবং এভাবে ধনীদেরকেই আরো ধনী বানাতে চায়।

ঋণ আদায় নিশ্চিত করার জন্য বন্ধক নেয়া কিংবা কারো নিকট বাকীতে মাল বিক্রি করে পাওনা আদায় নিশ্চিত করার জন্য ক্রেতার কাছ থেকে বন্ধক নেয়া শরীয়াহ্ অনুযায়ী বৈধ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন :

‘আর যদি তোমরা সফরে থাকো এবং কোন (চুক্তি দলিল-এর) লেখক না পাও তাহলে বন্ধকী বস্তু হস্তগত করা উচিত।

এ আয়াতে ঋণ আদায় নিশ্চিত করার জন্য বন্ধক নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এখানে সফরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হলেও সফর ছাড়া অন্য অবস্থায়ও বন্ধক নেয়া বৈধ, এ ব্যাপারে সকল ইমাম একমত। রাসূল ()-এর জীবন থেকেই এ ব্যাপারে দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।(ইসলামী ব্যাংকিং)

সহীহ বুখারীতে হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল () এক ইহুদির কাছ থেকে বাকিতে খাবার কিনে তাঁর লোহার বর্ম বন্ধক রেখেছিলেন।১২ রাসূলুল্লাহ () এ সময় কোন সফরে ছিলেন না। কুরআন ও সুন্নাহর এ বিধানের আলোকে এবং দেশের প্রচলিত আইনের চাহিদা অনুযায়ী ইসলামী ব্যাংক তার বিনিয়োগ নিশ্চিত করার জন্য বন্ধক নিয়ে থাকে।

ইসলামী ব্যাংক শুধু বন্ধক রাখতে সমর্থ লোকদেরকেই বিনিয়োগ সুবিধা দেয়, এ ধারণাও ঠিক নয় । ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড তার অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পল্লী এলাকার দরিদ্র, অসহায়, বিত্তহীন, ভূমিহীন নারী-পুরুষকে বিনিয়োগসুবিধা দিয়ে থাকে।

তাদেরকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য আয়বর্ধনমূলক বিভিন্ন পণ্য ব্যাংক বাজার থেকে কিনে তাদের কাছে সামান্য লাভে বিক্রয় করে। অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্য বিক্রয় করার ক্ষেত্রে ব্যাংক যে হারে লাভ ধার্য করে পল্লীর এ দরিদ্র লোকদের বেলায় লাভ ধার্য করে তারচে’ অনেক কম।

ইতোমধ্যে ইসলামী ব্যাংকের এ স্কীমের আওতায় ৩৭০০ গ্রামের দেড় লক্ষাধিক সদস্য পরিবার উপকৃত হচ্ছেন। এক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে কোন বন্ধক নেয়া হয় না। এছাড়াও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উন্নয়নের স্বার্থে ‘ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিনিয়োগ প্রকল্প’ নামের স্কীমের আওতায় ব্যাংক কোন প্রকার বন্ধক ছাড়াই বাই-মুয়াজ্জাল পদ্ধতিতে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ দিচ্ছে।

১৩ বড় ও মাঝারী ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের তুলনায় এখানেও ব্যাংকের লাভের হার কম। এভাবে ইসলামী ব্যাংক শুধু ধনীদের নয়, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক মান উন্নয়নের জন্যও কাজ করছে।(ইসলামী ব্যাংকিং)

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য সুদী ব্যাংকের সাথে লেনদেন

বাংলাদেশের সকল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের লেনদেন সুদভিত্তিক। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে লেনদেন করতে বাধ্য। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংক দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সুদী ব্যাংকের সাথেও লেনদেন করে। ফলে ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রমও সুদমুক্ত নয়।

এ অভিযোগ বিবেচনার আগে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইসলামী শরীয়াহ্ মুতাবিক ব্যাংকিং লেনদেন পরিচালনা করার জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংককে অনুমতি দিয়েছে। ইসলামী ব্যাংকগুলো শরীয়াহ্ মুতাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে কি না, তা নিশ্চিত করাও বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বের আওতায় পড়ে।

কোন ইসলামী ব্যাংক তার কাজ চালাতে গিয়ে যাতে শরীয়াহ্ পরিপালনে অসুবিধা বা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন না হয় তা দেখাও বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব। এ ব্যাপারে সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না এনে দূর থেকে তীর ছোঁড়ার মতো ঢালাও বা দায়িত্বহীন মন্তব্য করা ঠিক নয়।

ইসলামী ব্যাংক সুদভিত্তিক পরিবেশ ও আইন-কাঠামোগত প্রতিকূলতার মধ্যে তার কাজ শুরু করে। নিজেকে সুদের সাথে জড়িত না করার দৃঢ় অঙ্গীকারের কারণে এ ব্যাংক শুরু থেকে এ পর্যন্ত অনেক আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করেছে।

সেইসাথে তারা ইসলামী আইনকাঠামো ও বিকল্প সুবিধাদির ব্যবস্থা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট আবেদন জানিয়ে এসেছে। সে আবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য কিছু কিছু আইনগত ও অন্যান্য ব্যবস্থা করেছে, যদিও তা এখনো অপর্যাপ্ত।(ইসলামী ব্যাংকিং)

প্রতিটি বাণিজ্যিক ব্যাংক বর্তমানে তার মোট ডিপোজিটের ১৬% কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত বিধিবদ্ধ তারল্য সঞ্চিতি হিসেবে রাখতে বাধ্য। এ তারল্য সঞ্চিতির ৪% নগদ অর্থে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। বাকি ১২% অনুমোদিত বিভিন্ন বন্ড বা সিকিউরিটিতে রাখার সুযোগ রয়েছে।

সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলো তাদের সঞ্চিতির ১২% অর্থ বিভিন্ন সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করে সেখান থেকে বিরাট অংকের সুদ পেয়ে থাকে।শরীয়াহ অনুমোদিত কোন সিকিউরিটি বা বন্ড বাজারে না থাকায় ইসলামী ব্যাংক তাদের সম্পূর্ণ সঞ্চিতি নগদ অর্থে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে বাধ্য হয়।

এ ক্ষেত্রে সুদভিত্তিক ব্যাংকের সাথে তাদের সুযোগ-সুবিধা ও আয়ের বিরাট বৈষম্য সৃষ্টি হয়। এ বৈষম্য কিছুটা কমানোর জন্য ইসলামী ব্যাংকের আবেদনের প্রেক্ষিতে তাদের জন্য বিধিবদ্ধ তারল্য সঞ্চিতি ১০% করা হয়েছে।

এরপরও সুদী ব্যাংক যেখানে ৪% নগদ অর্থ রাখে সেখানে ইসলামী ব্যাংক ১০% অর্থাৎ তাদের বিধিবদ্ধ তারল্য সঞ্চিতির পুরোটাই নগদ জমা রাখতে বাধ্য হচ্ছে। সুদী ব্যাংকের তুলনায় ইসলামী ব্যাংক তার মোট ডিপোজিটের ৬% বেশি নগদ অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে বাধ্য হচ্ছে এবং এ বিপুল অর্থের সম্ভাব্য আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এ বৈষম্য দূর করতে ইসলামী শরীয়াহ্ভিত্তিক মুদারাবা বন্ড বাজারে ছাড়ার জন্য ইসলামী ব্যাংক সরকারের কাছে দীর্ঘদিন যাবৎ অনুরোধ জানিয়ে এসেছে। সম্প্রতি সরকার মুদারাবা বন্ড বাজারে ছেড়েছে।

এর ফলে আশা করা হচ্ছে যে, ইসলামী ব্যাংকগুলো একটি প্রতিকূল ও বৈষম্যমূলক অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে। মুদারাবা বন্ড বাজারে আসার পূর্বপর্যন্ত এদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো শুধু শরীয়াহ পরিপালন করতে গিয়ে যে বিরাট আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করেছে, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।

বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংক ইসলামী শরীয়াহ মুতাবিক পরিচালিত হচ্ছে। দ্রুত বিকাশমান এ ব্যাংকিং সিস্টেমের দাবি পূরণে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার ভবিষ্যতে আরো বেশি মনোযোগী হবেন এবং জনপ্রিয় ও জনকল্যাণমূলক এ ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করে এর অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

বিধিবদ্ধ তারল্য সঞ্চিতি ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের Foreign Currency Clearing Account-এ ইসলামী ব্যাংক তার বৈদেশিক মুদ্রা জমা রাখতে বাধ্য। এ অ্যাকাউন্টে বাংলাদেশ ব্যাংক LIBOR (London Inter- Bank Offering Rate) অনুযায়ী সুদ দিয়ে থাকে।(ইসলামী ব্যাংকিং)

আইনের বাধ্যবাধকতার কারণেই এ সুদ এসে যায়। ইসলামী ব্যাংকগুলো এ সুদ তার হালাল আয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে না। শরীয়াহ কাউন্সিলের মতামত ও সিদ্ধান্তের আলোকে শরীয়াহ অনুমোদিত খাতে তা ব্যয় করে থাকে।

কিছু অনিবার্য প্রয়োজনে ইসলামী ব্যাংক কোন কোন সুদী ব্যাংকে চলতি হিসাব খুলে তাতে অর্থ জমা রাখতে বাধ্য হয়। এসব কারেন্ট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কোন সুদ আসে না।

আরেকটি বিষয় হলো, সুদী ব্যাংকগুলো তাদের জরুরি তারল্য ঘাটতি মুকাবিলার প্রয়োজনে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে সুদের ভিত্তিতে টাকা ঋণ নিয়ে থাকে।

সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর পারস্পরিক প্রয়োজনে গড়ে ওঠা সুদভিত্তিক এ Call Money Market থেকে টাকা নেয়া ইসলামী ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। সুদভিত্তিক Money Market-এর বিপরীতে Islamic Money Market না থাকায় ইসলামী ব্যাংক তার জরুরি পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য সবসময় পর্যাপ্ত তারল্য (Liquidity) সংরক্ষণ করতে বাধ্য হয়।

সুদ বর্জন করার কারণেই ইসলামী ব্যাংক তার উদ্বৃত্ত তহবিল (Excess liquidity) অন্য সুদী ব্যাংকে Call Money হিসেবে সরবরাহ করা থেকেও বিরত থাকে । শুধুমাত্র সুদ থেকে বেঁচে থাকার জন্যই ইসলামী ব্যাংকের এ ভূমিকা।

বর্তমানে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এখন ইসলামী ব্যাংকসমূহ নিজেদের জরুরি প্রয়োজনে মুদারাবা পদ্ধতিতে নিজেদের মধ্যে প্রয়োজনীয় অর্থ লেনদেন করতে পারবে।

এসব লেনদেনের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত মূলধনের অধিকারী ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের মূলধন কাজে লাগিয়ে লাভ পেতে পারবে। অন্যদিকে তারল্য ঘাটতি মুকাবিলা করাও ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য এখন সহজ হবে ৷

আমদানি-রফতানিসহ নানা প্রকার বৈদেশিক বাণিজ্য ও লেনদেনের প্রয়োজনে ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদভিত্তিক বিভিন্ন বিদেশী ও আন্তর্জাতিক ব্যাংকের সাথে করেসপন্ডেন্ট সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও হিসাব পরিচালনা করতে বাধ্য হয়।

এসব লেনদেনে সুদ আদান-প্রদান পরিহার করার জন্য ইসলামী ব্যাংক সবসময় যত্নশীল। সুদভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো Over night Lending পদ্ধতিতে টাকা খাটায়।

আমেরিকা বা লন্ডনে যখন রাত হয় এবং সেখানে লেনদেন বন্ধ হয়ে যায় তখন ক্যানবেরা বা টোকিওতে দিনের সূচনা হয় এবং Money Market খুলে যায়। এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে সুদী ব্যাংকগুলো তাদের অর্থ বিভিন্ন ব্যাংকে খাটিয়ে সুদ পেয়ে থাকে।

এসব ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের Nostro Account-এর টাকাও Over night সুদে খাটায় এবং তাদের নিজস্ব নিয়মে হিসাব করে প্রাপ্য সুদ তারা ইসলামী ব্যাংকের Nostro Account এ দিয়ে দেয়।

অনিচ্ছাকৃতভাবে এসে যাওয়া এ সুদ ইসলামী ব্যাংক তার হালাল আয়ের সাথে যুক্ত করে না। ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড বা হিসাব গ্রাহকদের লাভের সাথে যোগ না করে এ সুদের অর্থ শরীয়াহ্ কাউন্সিল কর্তৃক নির্দেশিত বিভিন্ন খাতে ব্যয় করে।(ইসলামী ব্যাংকিং)

অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রাপ্ত সুদ-এর ব্যাপারে শরীয়ার ফয়সালা

রাবেতা আল আলম আল ইসলামীর ফিকাহ একাডেমী মক্কা মুকাররমায় ১৪০৬ হিজরীর রজব মাসে অনুষ্ঠিত নবম সম্মেলনে ঘোষণা করে :

“সুদের ভিত্তিতে আগত সকল সম্পদ শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম। ব্যাংকে টাকা জমাকারী কোন মুসলমান কোন অবস্থায় তার নিজের বা পোষ্যদের প্রয়োজনে উক্ত সুদ ব্যবহার করতে পারবে না।

উক্ত সম্পদ মুসলমানদের সাধারণ কল্যাণে যেমন বিদ্যালয়, হাসপাতাল ইত্যাদিতে ব্যয় করা তার ওপর ওয়াজিব। এ সম্পদ সদকাহ করার বিষয় নয় । এটা হারাম সম্পদ থেকে নিজেকে মুক্ত করার বিষয়।

এ সকল তাকওয়া অবলম্বনের উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট সুদী ব্যাংকে ছেড়ে দেয়া জায়েয নয়। বিদেশী ব্যাংকের সুদ এভাবে ছেড়ে দিলে বরং অধিক গুনাহ হবে । কেননা তারা সাধারণত এ অর্থ ইহুদি ও খ্রিস্টান মিশনারি সংস্থার কল্যাণে ব্যয় করে থাকে।

এভাবে মুসলমানদের সম্পদ মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ও মুসলিম সন্তানদের বিপথগামী করার হাতিয়ারে পরিণত হয়। তবে এ সকল সুদী ব্যাংকের সাথে সুদভিত্তিক অথবা সুদবিহীন লেনদেন অব্যাহত রাখা জায়েয নয়।(ইসলামী ব্যাংকিং)

সংশোধনের উদ্দেশ্যে সমালোচনা কল্যাণকর

ইসলামী ব্যাংকের সাথে সুদভিত্তিক প্রচলিত ব্যাংকের পার্থক্য মৌলিক । কাজের পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা। প্রচলিত ব্যাংক সুদের পদ্ধতি অবলম্বন করে। সুদই তাদের কার্যক্রমের ভিত্তি। প্রচলিত ব্যাংকে টাকা জমা রাখা বা ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সুদ দেয়া-নেয়ার বিষয়টি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

এ ক্ষেত্রে গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি হয় ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতা (Debtor- Creditor)। অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকের কাছ থেকে আল ওয়াদিয়া ও মুদারাবা পদ্ধতিতে জমা গ্রহণ করে এবং বাই-মুরাবাহা, বাই-মুয়াজ্জাল, বাই- সালাম, ইসতিসনা, মুদারাবা, মুশারাকা, ইজারা ইত্যাদি শরীয়াহ্ অনুমোদিত হালাল পদ্ধতিতে সে অর্থ বিনিয়োগ করে।

এ ক্ষেত্রে কেবলমাত্র বিনিয়োগের পদ্ধতি হালাল হলেই চলবে না। বিনিয়োগের খাতও হালাল হতে হবে। মদ, শূকরের গোশত বা তামাকের ব্যবসা হালাল পদ্ধতিতে করলেও তা বৈধ হবে না।(ইসলামী ব্যাংকিং)

ইসলামী ব্যাংকের সাথে সুদভিত্তিক ব্যাংকের মৌলিক পার্থক্য এ সকল নীতি ও পদ্ধতির মধ্যে নিহিত। এক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের সাবধানবাণী ও নিষেধাজ্ঞা লক্ষণীয় :

“হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্যনির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর-যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার । (সূরা মায়িদা : ৯০)

“শয়তান তো মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদের আল্লাহ্ স্মরণে ও সালাতে বাধা দিতে চায় । তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?” (সূরা মায়িদা : ৯১)(ইসলামী ব্যাংকিং)

“তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলুন, উভয়ের মধ্যে আছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও; কিন্তু তাদের পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক।” (সূরা বাকারা : ২১৯)

ইসলামী ব্যাংক শরীয়াহকে মানবজাতির কল্যাণের উৎস মনে করে এবং এ নীতির ভিত্তিতে সকল কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রচলিত ব্যাংকের এ ধরনের বিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি নেই।

এ দুই বিপরীতমুখী পদ্ধতিকে শুধুমাত্র আন্দাজ- অনুমানের ভিত্তিতে গুলিয়ে ফেলা বা এ দুই পদ্ধতির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই বলে দূর থেকে অজ্ঞতাপ্রসূত ও দায়িত্বহীন ঢালাও মন্তব্য করা একটি অনৈতিক ও অ-ইসলামী কাজ।(ইসলামী ব্যাংকিং)

যেকোন বিশ্বাসী ও সৎ মানুষের কর্তব্য হলো ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থার বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে ভালোভাবে জানার চেষ্টা করা এবং সংশোধনের উদ্দেশ্যে এর তথ্যভিত্তিক ও বাস্তবানুগ সমালোচনা করা। সুস্থ ও সুষ্ঠু সমালোচনার মাধ্যমেই এ ব্যবস্থার ত্রুটিমুক্ত বিকাশ এবং মানুষের কল্যাণে এর ভূমিকাকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।

আরো পড়ুন: বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রমের মূল্যায়ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.