ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন

ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলনের ইতিহাসকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায়ে এ আন্দোলন কেবল চিন্তা ও তত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে এ ব্যবস্থা কোথাও বেসরকারী উদ্যোগে এবং কোথাও আবার রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ নেয়।

পরাধীন মুসলিম দেশগুলোতে মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা দাবির সাথে তাদের বিশ্বাসভিত্তিক নিজস্ব বিধি-বিধানের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা যুক্ত ছিল। ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে মুসলিম সমাজ পুনর্গঠনের এই আকাঙ্ক্ষা বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এসে অধিকতর সংহত রূপ লাভ করে।

এ শতাব্দীর ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে ইসলামী অর্থনীতি ও সমাজ রচনার ক্ষেত্রে মুসলমানদের চিন্তার রাজ্যে ঝড় তোলেন আল্লামা ইকবাল, হাসান আল বান্না ও মওদূদীর মতো কয়েকজন বিশ্ববরেণ্য মনীষী।

Advertisement

ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন

চল্লিশের দশকে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান এবং আযাদী হাসিলের ফলে বিভিন্ন মুসলিম দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ইসলামী অর্থব্যবস্থা ও ব্যাংকব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি উচ্চকিত হতে থাকে।

পঞ্চাশের দশকে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে চিন্তা ও গবেষণা কার্যক্রম অধিকতর জোরদার হয়।

Advertisement

কুড়ি শতকের কতিপয় বিখ্যাত ইসলামী মনীষী ও অর্থনীতিবিদের দীর্ঘ গবেষণার মধ্য দিয়ে ইসলামী ব্যাংকিং বাস্তবতা লাভ করেছে। এ ক্ষেত্রে হিমালয়ান উপমহাদেশের ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা হিফযুর রহমান ও সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে প্রকাশিত তাঁদের গ্রন্থে গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করেন।

চল্লিশের দশকের শেষের দিকে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ আনোয়ার ইকবাল কোরেশী ইসলামী ব্যাংকিং-এর একটি কাঠামোগত ধারণা পেশ করেন।

Advertisement
ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন

১৯৫২ সালে শেখ মাহমুদ আহমদ তাঁর ‘Economics of Islam’ নামক প্রবন্ধে জয়েন্ট স্টক কোম্পানীর ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিষয় উত্থাপন করেন। (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন)

১৯৫৫ সালে মোহাম্মদ উজায়ের তাঁর ‘An outline of interestless banking’ শীর্ষক প্রবন্ধে ইসলামী ব্যাংকের কর্মপদ্ধতিতে মুদারাবা মূলনীতি সংযুক্ত করার কথা বলেন ।

মোহাম্মদ আল-আরাবী (১৯৬৬) ও এস এ ইরশাদ (১৯৬৪) ইসলামী ব্যাংকের কর্মকৌশল হিসেবে মুদারাবা নীতি অনুসরণের পরামর্শ দেন।

১৯৬৮ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ডঃ নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকী মুদারাবা নীতির ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের দ্বি-স্তর বিশিষ্ট মডেল উপস্থাপন করেন।

Advertisement

পরবর্তীতে তিনি মুশারাকা নীতি অন্তর্ভুক্ত করে ফান্ড ব্যবস্থাপনার দ্বি-স্তর বিশিষ্ট মডেল অধিকতর সম্প্রসারণের প্রস্তাব করেন। ১৯৮২ সালে এম মোহসিন আধুনিক পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালুর ব্যাপারে একটি বিস্তৃত কাঠামোগত ধারণা উপস্থাপন করেন।

ষাটের দশক : ভোরের আভাস : ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন

ষাটের দশকের শুরুতে ১৯৬১ সালে মিসরে ইসলামী গবেষণার সর্বোচ্চ কেন্দ্ররূপে ‘কলেজ অব ইসলামিক রিসার্চ’ কায়েম করা হয়। ১৯৬৪ সালের ৭ মার্চ এ কলেজের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ৪০টিরও বেশি মুসলিম দেশের শতাধিক নেতৃস্থানীয় ইসলামবিশেষজ্ঞ যোগদান করেন। (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন)

তাঁরা সুদভিত্তিক প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থার বিকল্পরূপে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি গড়ে তোলার উপায় নিয়ে আলোচনা করেন।

এ সম্মেলনে সর্বসম্মত অভিমত ঘোষণা করা হয় যে, ভোগ বা উৎপাদন যেকোন উদ্দেশ্যে ঋণের ওপর ধার্যকৃত বাড়তি অর্থ, পরিমাণে কম হোক বা বেশি হোক, তা নিষিদ্ধ ‘রিবা’র পর্যায়ভুক্ত।

Advertisement

সম্মেলনে ব্যাংকিং কার্যক্রমের কতিপয় ইসলামী পদ্ধতিও অনুমোদন করা হয়। অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আরো কতিপয় বিষয় গ্রহণ করা হয়। এ সম্মেলনে প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থার ইসলামী বিকল্প উদ্ভাবনের ব্যাপারে মুসলিম মনীষী ও অর্থনীতিবিদগণের মতামত আহ্বান করা হয় ।

১৯৬২ সালে মালয়েশিয়ায় কিস্তিতে হজ্জের অর্থ জমা গ্রহণের উদ্দেশ্যে ‘পিলগ্রিমস সেভিংস কর্পোরেশন’ নামে সুদমুক্ত একটি সংস্থা কায়েম করা হয় । (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন)

এরপর ১৯৬৩ সালে ডক্টর আহমদ আল নাজ্জারের উদ্যোগে মিসরের কায়রো থেকে একশ’ কিলোমিটার দূরে ‘মিটগামার’ নামক এক গ্রামে আধুনিক বিশ্বের প্রথম সুদমুক্ত ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়।

১৯৬৯ সালে মালয়েশিয়ার পার্লামেন্টে আইন পাস করে ইসলামী শরীয়াহ্ ভিত্তিক সঞ্চয় প্রতিষ্ঠানরূপে “তাবুং হাজী’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

সরকারী পর্যায়ে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার এ উদ্যোগ ইসলামী ব্যাংকিং-এর জন্য এক ধাপ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হয়। এভাবে ষাটের দশক ইসলামী ব্যাংকিং-এর বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষার দশকরূপে চিহ্নিত হয়। (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন)

সত্তরের দশক : নতুন সূর্যোদয় : ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন

১৯৭৪ সালে ইসলামী সম্মেলন সংস্থাভুক্ত দেশগুলো শরীয়াহ্ভিত্তিক ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সনদ স্বাক্ষর করে।

এ উপলক্ষে সদস্য দেশসমূহের মন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সম্মেলনে এক আবেগপূর্ণ ভাষণে সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশাহ ফয়সল বিন আবদুল আযীয মুসলমানদের অবস্থাকে মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া সেই উটের সাথে তুলনা করেন, যার পিঠে মশকভর্তি পানি থাকা সত্ত্বেও সে উট পিপাসার্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন)

মুসলিম উম্মাহর প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র নিয়ে ১৯৭৫ সালে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) যাত্রা শুরু করে। আইডিবি প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে সত্তরের দশকের শেষ নাগাদ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে কুড়িটিরও বেশি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

তার মধ্যে শেখ সাঈদ আহমদ লুতাহ-এর উদ্যোগে ‘দুবাই ইসলামিক ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালে। মিসর ও সুদানে ‘ফয়সাল ইসলামিক ব্যাংক’ নামে ১৯৭৭ সালে আরো দু’টি বেসরকারী ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।

একই বছর কুয়েতে শেখ আহমদ বা’জি আল ইয়াসিনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করে কুয়েত ফাইন্যান্স হাউজ’। (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন)

বিভিন্ন মুসলিম দেশ ছাড়াও ডেনমার্ক, লুক্সেমবার্গ, সুইজারল্যাণ্ড ও যুক্তরাজ্যে এ সময় কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে সত্তর দশক ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার দশকরূপে চিহ্নিত হয়।

আশির দশক : সংহত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ

হিজরী চৌদ্দ শতককে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে আশির দশকের সূচনা হয়। নতুন হিজরী শতক মুসলিম উম্মার জন্য নতুন আশা আর তাজা উদ্যম নিয়ে হাজির হয়। মুসলিম দুনিয়া এ শতাব্দীকে ইসলামী রেনেসাঁর শতাব্দীরূপেও চিহ্নিত করে।

এ পটভূমিতে আশির দশকের শুরু থেকে বিভিন্ন দেশে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গতি ও আবেগ সঞ্চারিত হয়। সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরামে এ দশকে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে জোরদার প্রচেষ্টা চলতে থাকে। (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন) এ ব্যবস্থার পরিচালনগত সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে এ সময় নানামুখী বাস্তব পদক্ষেপ গৃহীত হয়।

১৯৮০ সালের মে মাসে ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একাদশ সম্মেলন ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রফেসর মুহাম্মদ শামস- উল-হক এ সম্মেলনে ইসলামী আধুনিক ব্যাংকব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান, যার শাখা সকল সদস্য দেশে সম্প্রসারিত হবে। তিনি ইসলামিক কমন মার্কেট প্রতিষ্ঠারও প্রস্তাব করেন।

১৯৮১ সালের জানয়ুারিতে মক্কা ও তায়েফে তৃতীয় ইসলামী শীর্ষ সম্মেলন অনষ্ঠিু ত হয়। (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন) বাংলাদেশের তৎকালীন
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শীর্ষ সম্মেলনের পূর্ণার্ণঙ্গ অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে মসলমানদের নিজস্ব ও স্বতন্ত্র’
ব্যাংকুর্ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন :

‘The Islamic countries should develop a separate banking system of their own in order to facilitate their trade and commerce.’

১৯৭৯ সালে ইরানে রাজতন্ত্রে র উৎখাত করে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত
হবার পর ১৯৮১ সাল থেকে সেদেশের গোটা ব্যাংকব্যবস্থা ইসলামী পদ্ধতিতে ঢেলে সাজানোর পদক্ষেপ
নেয়া হয়। ১৯৮১ সালে পাকি স্তানও রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী ব্যাংকিং চালরু সিদ্ধান্ত নেয়। ১

১৯৮১ সালে ইসলামী সম্মে লন সংস্থার সদস্য দে শসমহেূহের কে ন্দ্রীয় ব্যাংক ও মদ্রুা নি য়ন্ত্রণ সংস্থার
প্রধানদে র খার্তুমে অনষ্ঠিুষ্ঠিত সম্মে লনে ইসলামী (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন)ব্যাংক প্রতি ষ্ঠার ব্যাপারে একটি সর্বসম্মত কাঠামো
উদ্ভাবনে র প্রস্তাব গৃহীত হয়।

১৯৮৩ সালে মালয়ে শিয়ায় ও তুরস্কে ইসলামী ব্যাংকিং আইন পাস করা হয়। (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন) ১৩ ১৯৮৪ সাল থে কে
ইরান তার সার্বি ক ব্যাংকব্যবস্থা ইসলামী শরীয়ার আলোকে পুনর্গঠর্গন করে। ১৪

পাকি স্তানের সার্বিক ব্যাংকিং খাত পর্যায়ক্রমি কভাবে পুনর্গঠর্গ নের সিদ্ধান্তও এ সময়ই গৃহীত হয়। ১৯৮৫
সালে র ১ জলুাই থে কে পাকি স্তানে সুদভিত্তিক ব্যাংকিং লেনদেন সম্পূর্ণরূর্ণ পে নিষিদ্ধ করা হয়। সুদানের
ব্যাংকব্যবস্থা শরীয়ার আলোকে পুনর্গঠর্গনের জন্যও এ সময় উদ্যেগ নেয়া হয়। ১৫

আশির দশকের প্রথম সাত বছরে নতুন ৫৬টি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। মসুলিম-অমসুলিম নির্বিশেষে
দনিু য়ার বিভিন্ন দেশে আশির দশকের শেষ নাগাদ একশ’টির বেশি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৬

নব্বই দশক: দৃঢ় ভিত্তি

নব্বই দশকে সারাবিশ্বে ইসলামী ব্যাংকগুলো দৃঢ় ভিত্তি লাভ করে । এ সকল ব্যাংকের পরিচালনগত সাফল্য ইসলামী ব্যাংকিং-এর প্রতি বিশ্বের ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া সৃষ্টিতে সমর্থ হয়। (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন) ফলে দেশে দেশে ইসলামী ব্যাংক তথা সুদবিহীন ব্যাংকের প্রসার বৃদ্ধি পায়।

ইরান, পাকিস্তান ও সুদানের সামগ্রিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইসলামীকরণসহ সারাবিশ্বে কুড়ি শতকের শেষ নাগাদ তিনশ’র বেশি ইসলামী ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান অস্তিত্ব লাভ করে।

১৭ ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ও ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ইসলামিক ব্যাংকস্ (আইএআইবি)-র উদ্যোগে ইসলামী ব্যাংকসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা এ সময় বৃদ্ধি পায় । নীতি ও পদ্ধতিগত বিভিন্ন বিষয়ে পারস্পরিক সমন্বয় ও সংযোগ দৃঢ়তর হয় । (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন)

ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক রূপলাভে সক্ষম হয়েছে। শুধু তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোতেই নয়, অনেক স্বল্পোন্নত দেশেও ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাছাড়া মুসলিমবিশ্বের বাইরেও ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকসমূহের তালিকার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এ যাবত তেলসমৃদ্ধ মুসলিম দেশসমূহে যে কয়টি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারচেয়ে বেশি সংখ্যক ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অন্যান্য দেশে।

উদাহরণস্বরূপ সুদান, মিসর, পাকিস্তান, জর্দান, লুক্সেমবার্গ, যুক্তরাজ্য এমনকি বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব দেশের আর্থ- সামাজিক অবস্থায় রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্র্য ও বৈসাদৃশ্য। এ থেকেই এটা প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী ব্যাংকিং মডেল সার্বজনীনতা ও বিশ্বজনীনতা লাভে সমর্থ হয়েছে ।

একাডেমিক গবেষণা ও অধ্যয়নের দিক থেকেও ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে ইতোমধ্যে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ব্যাংকিং এখন একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে পঠিত হচ্ছে। এ বিষয়ে উচ্চতর গবেষণা ও ডিপ্লোমা সনদ প্রদান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

একনজরে ইসলামী ব্যাংকিং বিকাশের ক্রমধারা

ইসলামী নীতিমালার আলোকে ১৯৬২ সালে মালয়েশিয়ায় ‘Pilgrims Savings Corporation’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

মিসরের মিটগামারে ১৯৬৩ সালে ‘সেভিংস ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৬৯ সালে মালয়েশিয়ায় ‘তাবুং হাজী’ নামে একটি বিশেষায়িত ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৭০ সালে ওআইসি দেশসমূহের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ মুসলিম দেশসমূহে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালে মিসরের কায়রোতে ‘নাসের স্যোসাল ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৭৩ সালে ওআইসি দেশসমূহের অর্থমন্ত্রীগণ একটি আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ৷

O ১৯৭৪ সালে ওআইসি দেশসমূহের অর্থমন্ত্রীগণ আইডিবি চার্টারে স্বাক্ষর করেন।

১৯৭৫ সালে জেদ্দায় ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৭৫ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘দুবাই ইসলামী ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

O ১৯৭৭ সালে সুদানে ‘ফয়সাল ইসলামিক ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৭৭ সালে কুয়েতে ‘কুয়েত ফাইন্যান্স হাউস’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৭ সালে সৌদি আরবে ‘International Association of Islamic Banks’ (IAIB) গঠিত হয়। (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন)

১৯৭৮ সালে জর্দানে ‘জর্দান ইসলামিক ব্যাংক ফর ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

O ১৯৭৮ সালে পাকিস্তান তার সমগ্র ব্যাংক ব্যবস্থাকে ইসলামীকরণের ঘোষণা দেয়।

পাকিস্তানে ১৯৭৮ সালে সামগ্রিক ব্যাংক ব্যবস্থাকে ইসলামী পদ্ধতিতে ঢেলে সাজানোর পদক্ষেপ নেয়া হয়।” এ লক্ষ্যে-

১৮ ক. প্রাথমিকভাবে তিনটি সরকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সুদমুক্ত করা

হয়। সেগুলো হলো, The House Building Corporation of Pakistan, National Investment Trust

Mutual Trust

Funds of Investment Corporation of Pakistan.

খ. ‘লাভ-লোকসান’ অংশীদারিত্বেরভিত্তিতে (Profit – Loss Sharing বা PLS) জমা গ্রহণের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহে আলাদা কাউন্টার খোলা হয় ।

A.

গ. আমদানি-রফতানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুদমুক্ত বিনিয়োগ প্রদানের অনুমতি দিয়ে ‘স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান’-এর পক্ষ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ধারাবাহিকভাবে কিছু নির্দেশনা দেয়া হয় ৷

(ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন )১৯৮৪ সালের এক ঘোষণার মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার এক বছরের মধ্যে দেশে দুই ধারার ব্যাংকিং-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ইসলামী পদ্ধতিতে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয় ৷

ব্যাংকারগণ দীর্ঘদিন সুদভিত্তিক গতানুগতিক ব্যাংকিং পদ্ধতিতে অভ্যস্ত থাকায় সরকার কর্তৃক আনীত এসব পরিবর্তন মেনে নিতে মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না।

ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং-এর ব্যাপারে ধারণাগত ও মানসিক প্রস্তুতির অভাবের কারণে উপর থেকে আরোপিত এ নতুন ব্যবস্থার প্রতি ব্যাংকারদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

ঙ. ইরান সরকার ১৯৭৯ সাল থেকে তার সামগ্রিক ব্যাংক ব্যবস্থা ইসলামী পদ্ধতিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে ধারাবাহিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ ব্যাপারে তারা তিনটি ধাপে অগ্রসর হয় ।

১৯. ক. প্রথম ধাপ – ১৯৭৯-১৯৮২ : গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থা জাতীয়করণ, কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠন।

খ. দ্বিতীয় ধাপ – ১৯৮২-১৯৮৬ ঃ এ পর্বে ইসলামী ব্যাংকিং-এর জন্য প্রয়োজনীয় আইন কাঠামো তৈরি করা হয় এবং এ নতুন সিস্টেমকে ধারণ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়া হয়।

গ. তৃতীয় ধাপ – ১৯৮৬ সাল থেকে ইসলামী সরকারের অবিচ্ছেদ্য দায়িত্ব হিসেবে ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য অর্জনে ব্যাংকসমূহের ভূমিকা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ হিসেবে এ খাতে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস করা হয়।

ব্যাংকিং কাঠামোর পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে ইরান সরকার সেবা ও ভোগ খাত থেকে আর্থিক সম্পদসমূহ উৎপাদন খাতে স্থানান্তরের জন্য চারটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যথা :

১. স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগ সম্প্রসারণ স্থগিত এবং মধ্যমেয়াদী বিনিয়োগের আকৃতি কমিয়ে আনা।

২. কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বীজ, সার, কৃষিসরঞ্জাম ও শস্যবীমা চালু করার ক্ষেত্রে সরকারী ভর্তুকি প্রদানসহ কৃষিখাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ সম্প্রসারণ।

৩. কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য সমবায় খাতকে উৎসাহিত করতে ব্যাংক-ব্যবস্থাকে কাজে লাগানো।

৪. সরকারের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বড় শিল্প ও সামাজিক খাতে বিনিয়োগে ব্যাংকসমূহের অংশগ্রহণ

১৯৮৩ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম ইসলামী ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৮৩ সালে তুরস্ক ও মালয়েশিয়ায় ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৯১ সালের ২৭ মার্চ বাহরাইনে ‘The Accounting and Auditing Organization for Islamic Financial Institutions’ (AAOIFI) ‘আওইফি’ একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত হয়।

এর আগে ১৯৯০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আলজিয়ার্সে স্বাক্ষরিত চুক্তি মুতাবেক ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য অ্যাকাউন্টিং, অডিটিং, গভর্নেস, ইথিকস্ এবং শরীয়াহ্ বিষয়ক স্ট্যান্ডার্ড প্রণয়নের লক্ষ্যে ‘আওইফি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০

→ শরীয়াহ মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিদ্যমান আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড চালু এবং নতুন নতুন স্ট্যান্ডার্ড প্রণয়নের মাধ্যমে একটি দূরদর্শী ও স্বচ্ছ ইসলামী আর্থিক সেবাশিল্পের বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় International Financial Services Board বা IFSB। (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন)

আইডিবি, আইএমএফ এবং আওইফি’র সহযোগিতায় বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও মনিটারি অথরিটির শীর্ষ নির্বাহীবৃন্দের উদ্যোগে ২০০২ সালের ৩ নভেম্বর কুয়ালালামপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে IFSB যাত্রা শুরু করে ৷২১

→ বিশ্বব্যাপী জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য ইসলামী অর্থনীতির ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও নৈতিক দিকনির্দেশনা প্রদানে সক্ষম ‘নলেজ লিডার’ তৈরি করার লক্ষ্যে মালয়েশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ব্যাংক নেগারা মালয়েশিয়া’র পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০৬ সালে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর এডুকেশন ইন ইসলামিক ফাইন্যান্স বা ইনসেইফ’ (INCEIF)।

মালয়েশিয়ার ১৯তম বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাপ্রাপ্ত ইনসেইফ শিক্ষার্থীদের ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞানদানের পাশাপাশি মাস্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানেরও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে । ২২

এ পর্যন্ত যেসকল দেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে

১. আফগানিস্তান, ২. আলজেরিয়া, ৩. আলবেনিয়া, ৪. আর্জেন্টিনা, ৫. অস্ট্রেলিয়া, ৬. বাহামা, ৭. বাহরাইন, ৮. বাংলাদেশ, ৯. ব্রুনেই, ১০. কেইমান দ্বীপপুঞ্জ, ১১. সাইপ্রাস, ১২. ডেনমার্ক, ১৩. জিবুতি, ১৪. মিসর, ১৫. জার্মানি, ১৬. গিনি, ১৭. গাম্বিয়া, ১৮, ভারত, ১৯. ইন্দোনেশিয়া, ২০. ইরান, ২১. ইরাক, ২২. জর্দান, ২৩. কাজাকিস্তান, ২৪. কিবরিজ তুর্কী প্রজাতন্ত্র, ২৫. ২৫. কুয়েত, ২৬. লেবানন, ২৭. লিচটেনস্টিন, ২৮. লুক্সেমবার্গ, ২৯. মালয়েশিয়া, ৩০. মৌরিতানিয়া, ৩১. মরক্কো, ৩২. নাইজার, ৩৩. পাকিস্তান, ৩৪. প্যালেস্টাইন, ৩৫. ফিলিপাইন, ৩৬. কাতার, ৩৭. রাশিয়া, ৩৮. সৌদি আরব, ৩৯. সেনেগাল, ৪০. দক্ষিণ আফ্রিকা, ৪১. সুদান, ৪২. সুইজারল্যান্ড, ৪৩. থাইল্যান্ড, ৪৪. তিউনিসিয়া, ৪৫. তুরস্ক, ৪৬. সংযুক্ত আরব আমিরাত, ৪৭. যুক্তরাজ্য, ৪৮. যুক্তরাষ্ট্র, ৪৯. ইয়েমেন এবং ৫০. বসনিয়া ।

আন্তর্জাতিক সংস্থার মূল্যায়ন

সাইপ্রাসভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন সংস্থা ‘ক্যাপিটাল ইন্টেলিজেন্স’ এক গবেষণা জরিপে এভাবে উপসংহার টেনেছে যে, (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন) সাম্প্রতিক বিশ্বে ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থা ক্রমশ অধিকতর ক্রেডিবিলিটি অর্জন করে চলেছে। (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন)

বহু দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে এ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারেও ব্যাপকতর গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে ।

লন্ডনের ফিনান্সিয়াল টাইমস’-এর সিন্ডিকেশন সার্ভিসের প্রতিবেদক মার্ক হাসবেন্ড এক মূল্যায়নে দেখিয়েছেন, বিশ্বের ইসলামী ব্যাংকসমূহের বিনিয়োগ মূলধনের শতকরা ৫৬ ভাগ যোগান দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ।

তার মধ্যে উপসাগরীয় দেশসমূহের অংশীদারিত্ব ১৮%। এরপরই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অংশীদারিত্ব ১৪%, ইউরোপ ৭%, আফ্রিকা ৩% এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ২%। (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন)

ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবসায়ের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণে বহু সুদভিত্তিক আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ইতোমধ্যে ইসলামী পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকেছে । (ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন)

বিশ্বের কর্তৃত্বশীল সিটি গ্রুপের ‘গ্লোবাল ইসলামিক ফিন্যান্স গ্রুপ’, দি ইউএস গ্রুপ-এর ‘ইসলামিক ফান্ড’, এইচএসবিসি-এর ‘গ্লোবাল ইসলামিক ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্ট’ তাদের গ্রাহকদের সামনে শরীয়াহ্ অনুমোদিত নানা পদ্ধতি ও সেবা হাজির করে চলেছে।

3 thoughts on “ইসলামী ব্যাংকিং আন্দোলন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.