স্থানীয় এবং বিশ্ব অর্থবাজারে ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার অন্তর্ভুক্তি সমাদৃত হয়েছে। তারপরও আন্তর্জাতিক অর্থবাজারের চাহিদা পূরণের উপযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিকশিত হতে হলে এ ব্যবস্থাকে আরো অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে।
বিশ্বব্যাপী ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থার প্রাথমিক সাফল্যের কারণ হলো ইসলামী তহবিল সংগ্রহ ও বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ এবং এর নৈতিক মূল্যবোধ সমন্বিত কল্যাণধর্মী লক্ষ্য ও আদর্শ।
ইসলামী ব্যাংকসমূহের স্থায়িত্ব ও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে হলে এক্ষেত্রে সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাসমূহ দক্ষতার সাথে মুকাবিলা করেেত হবে। এ প্রসঙ্গে এখানে কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত করা হলো।
প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো
সুদভিত্তিক ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রায় তিনশ’ বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছেছে। অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংক এ সুদভিত্তিক ও পুঁজিতান্ত্রিক ব্যাংক ব্যবস্থার সাংগঠনিক কাঠামো ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ ও আবহের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং পরিচালিত হচ্ছে।
ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রচলিত ব্যাংক-ব্যবস্থার বিপরীত। ইসলামী অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের উপযোগী নিজস্ব সাংগঠনিক এবং ব্যবস্থাপনা কাঠামো ছাড়া ইসলামী ব্যাংকসমূহের লক্ষ্য অর্জন একটি দুরূহ কাজ।
ইসলামী ব্যাংক প্রচলিত ব্যাংকিং কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হওয়ায় এর বণ্টন-দক্ষতা কমে যায়। লাভ-লোকসানভিত্তিক বিনিয়োগপদ্ধতি অনুসরণ ছাড়া উদ্যোক্তা, জমাকারী ও ব্যাংকের মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ব্যাহত হয়।
প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যাংক-ব্যবস্থার মনস্তাত্ত্বিক আবহে পরিচালিত হবার কারণেই অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংক প্রধানত বাই-মুরাবাহা, বাই-মুয়াজ্জাল এবং বাই-সালাম তথা কেনা-বেচা পদ্ধতিতে তাদের বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করে, যা প্রচলিত ধারার প্লেজ ও হাইপোথিকেশনের জায়েয বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যবস্থার সাথে বেচা-কেনা পদ্ধতির সুস্পষ্ট পার্থক্য থাকলেও সাধারণ জনগণের কাছে সে পার্থক্যটি ব্যাপকভাবে বোধগম্য হয় না। এ কারণে জনগণের কাছে প্রচলিত ধারার ব্যাংক ব্যবস্থা ও ইসলামী ব্যাংকিং-এর মধ্যকার পার্থক্য সুস্পষ্ট হচ্ছে না।
মুদারাবা ও মুশারাকা পদ্ধতি প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাথে কোনভাবেই সামঞ্জস্যশীল নয়। সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এর কোন বিকল্প নেই।
ইসলামী ব্যাংকগুলো এখনও ব্যাপকভাবে মুদারাবা ও মুশারাকা বিনিয়োগপদ্ধতির চর্চা করতে না পারায় ইসলামী ব্যাংকিং-এর মৌলিক স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে সাধারণ্যে ধারণা সুস্পষ্ট হচ্ছে না।
অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংক প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যাংক-ব্যবস্থার পরিবেশের মধ্যে কাজ করছে। ফলে এসব ব্যাংকে শরীয়াহ্ পরিপালন নিশ্চিত করার জন্য স্বাধীন, শক্তিশালী ও দক্ষতাসম্পন্ন শরীয়াহ্ সংস্থার মাধ্যমে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান দরকার।
ইসলামী ব্যাংক এমন একটি পরিবেশে কাজ করছে যেখানে আইন, প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ এবং মানসিক বিন্যাস সুদভিত্তিক অর্থনীতির উদ্দেশ্য পূরণেরই উপযোগী। এ পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে ইসলামী ব্যাংকিং মূলনীতির বাস্তবায়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
গবেষণার ফলে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, ইসলামী ব্যাংক অনন্য ব্যবস্থা হিসেবে স্বাধীন পরিবেশে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করার মাধ্যমেই অর্থনীতিতে তার কল্যাণকারিতার যথাযথ পূর্ণাঙ্গ স্বাক্ষর রাখতে পারে।
ইসলামী জ্ঞান ও পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন ব্যাংকারের ঘাটতি
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা এবং বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রভাবের মধ্যে বেড়ে ওঠার কারণে অধিকাংশ ব্যাংকারই পুঁজিবাদী অর্থনীতির আবহ, এর লক্ষ্য ও মনস্তত্ত্ব দ্বারা আচ্ছন্ন। এ পরিবেশেই তারা প্রশিক্ষিত।
ফলে ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে তাদের অনেকেরই প্রত্যয় ও অন্তর্দৃষ্টি এবং মানসিক প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে। তাদের সার্বিক প্রয়োজনকে সামনে রেখে ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে জ্ঞানগত ভিত্তি নির্মাণ, মোটিভেশন প্রদান ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদানের প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন খুবই সীমিত।
ইসলামী ব্যাংকের জন্য অধিকতর মেধা ও দক্ষতাসম্পন্ন এবং চ্যালেঞ্জ নেয়ার মতো ব্যাংকার প্রয়োজন। কারণ ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত পেশাজীবীদেরকে সদ্য বিকাশমান পদ্ধতির জন্য নতুন নতুন প্রোডাক্ট উদ্ভাবন করতে হবে।
গ্রাহকের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে শরীয়ার আলোকে পূরণ করার মাধ্যমেই ইসলামী ব্যাংক তার শ্রেষ্ঠত্ব ও শ্রেয়ত্ব প্রমাণ করতে পারে।
ইসলামী ব্যাংকিংয়ের উন্নততর, স্বতন্ত্র ও বহুলাংশে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগপদ্ধতির কারণে শিল্প, প্রযুক্তি এবং ব্যবসা পরিচালনা সম্পর্কে ইসলামী ব্যাংকারদের অনেক বেশি বাস্তব ধারণা ও জ্ঞান থাকা জরুরি।
অধিকন্তু বিনিয়োগ ও ব্যবসায়ে ইসলামী নৈতিকতা ও ইসলামী অগ্রাধিকার এবং বৈধ ও অবৈধতার শারঈ সীমারেখা সম্পর্কে তাদের সচেতন থাকা জরুরি।
ইসলামী ব্যাংকের কর্মীবাহিনী যাতে ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী, দক্ষতা এবং জ্ঞানের প্রয়োজনীয় ভিত্তি অর্জন করতে পারে, সেজন্য ব্যাপক ও অব্যাহত পরিচর্যা দরকার, যাতে করে তারা ইসলামী পদ্ধতির পূর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজের প্রয়োজন পূরণে কার্যকর অবদান রাখতে পারেন।
ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে গ্রাহকদের ধারণা উন্নয়ন
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক পরিবেশের কারণে এবং দীর্ঘদিন ইসলামী আর্থিক লেনদেন চালু না থাকার দরুন ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে গ্রাহকদের ধারণা ও জ্ঞান খুবই সীমিত কিংবা শূন্যের কোঠায়। কোন কোন ক্ষেত্রে তা নেতিবাচক।
অধিকাংশ বিনিয়োগ গ্রাহকেরই সুদ ও লাভের মধ্যে পার্থক্য, শরীয়াহ অনুমোদিত বিনিয়োগপদ্ধতি, হালাল-হারামের জ্ঞান এবং ইসলামী আইনের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক লেনদেন পরিচালনার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ধারণা নেই।
শরীয়াহ্র মৌলিক জ্ঞান এবং হালাল-হারামের নীতির প্রতি শ্রদ্ধা ব্যতীত ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালনা খুবই কঠিন। এজন্য গ্রাহককে সাধ্যমত ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা ইসলামী ব্যাংকসমূহের এক গুরুত্বপূর্ণ কঠিন দায়িত্ব।
গ্রাহকগণকে ইসলামী ব্যাংকিংমুখী করার প্রয়াস এখনো এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবেই রয়ে গেছে। একদিকে গ্রাহকদের শরীয়াহ সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব এবং অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংকসমূহ শুধুমাত্র বাই-মুরাবাহা ও বাই-মুয়াজ্জালের মতো পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করার কারণে প্রচলিত ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় করা গ্রাহকদের পক্ষে কঠিন হচ্ছে।
প্রচলিত ব্যাংক-ব্যবস্থায় ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্ক দেনাদার- পাওনাদার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংক- ব্যবস্থায় এ সম্পর্ক হলো সাহিব আল মাল ও মুদারিব, মুয়াদ্দা- মুয়াদ্দি, ব্যবসায়ে অংশীদার, পণ্যের ক্রেতা-বিক্রেতা ইত্যাদি । গ্রাহকদের কাছে এ বিষয়ে ধারণা এখনো স্পষ্ট নয়।
অধিকাংশ বিনিয়োগ গ্রাহক তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত এবং বিনিয়োগসুবিধার ব্যাপারেই তারা বেশি আগ্রহী।
এ অবস্থায় ইসলামী ব্যাংকিং-এর পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের মধ্যে জানার আগ্রহ ও সুযোগ সৃষ্টি করা এক দুরূহ কাজ। ইসলামী ব্যাংক- ব্যবস্থার সফলতার জন্য এ চ্যালেঞ্জ মুকাবিলা করা ইসলামী ব্যাংকারদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি।
তাত্ত্বিক গবেষণা ও জ্ঞানের সমন্বয়
প্রচলিত ধারার ব্যাংক-ব্যবস্থায় লেনদেন ও বিভিন্নমুখী সেবার প্রোডাক্টগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দীর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উদ্ভাবিত ও বিকশিত হয়েছে। এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থা নতুন।
তবে ইসলামী পদ্ধতিতে নতুন নতুন প্রোডাক্ট উন্নয়ন ও উদ্ভাবনের অনেক বেশি সুযোগ ও ক্ষেত্র রয়েছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে সামনে রেখে ইসলামী ব্যাংকগুলোর নতুন নতুন প্রোডাক্ট উদ্ভাবন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অব্যাহত প্রক্রিয়া।
বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকসমূহ গ্রাহকদের ক্রমবর্ধমান বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজন ও নতুন নতুন চাহিদা মেটাতে নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।
ইসলামী শরীয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অথচ সুদভিত্তিক ব্যাংকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, এমন আর্থিক ইনস্ট্রুমেন্ট তৈরির জন্য ইসলামী ব্যাংকার ও শরীয়াহ্ বিশেষজ্ঞদের নিরন্তর ও সমন্বিত প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে।
অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংকের গবেষণা ও উন্নয়নে (R & D) প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ ও লোকবলের অভাব রয়েছে। এ অভাব ও ঘাটতি দূর করা ইসলামী ব্যাংকিংয়ের পূর্ণ বিকাশের জন্য অত্যাবশ্যক এবং তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে টিকে থাকার জন্যও জরুরি।
ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য ইসলামী চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ ও পেশাদার ব্যাংকারদের মধ্যে জ্ঞান ও চিন্তার সমন্বয় (Knowledge sharing) প্রয়োজন। এর মাধ্যমেই এ ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট সবাই বাস্তব চাহিদা অনুযায়ী অবদান রাখতে পারেন।
গ্রাহকের ব্যাংকিং প্রয়োজন পূরণকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে ইসলামী নীতির ব্যাপারে আপোস করার বা ইচ্ছামতো লাগসই করার একটি প্রবণতা অনেক সময় কোন কোন ইসলামী ব্যাংকের কিছু কিছু ব্যাংকারের মধ্যে কাজ করে।
অথচ ইসলামী ব্যাংকিং-এর মূল উদ্দেশ্য হলো লেনদেনের ক্ষেত্রে শরীয়াহ পুরোপুরি প্রতিপালন করা। ইসলামী বিধিবিধানের সীমার মধ্যে থেকেই তাদের কাজকে এগিয়ে নেয়ার মানসিকতা অর্জন করতে হবে এবং তা এগিয়ে নিতে অভ্যস্ত হতে হবে।
ইসলামী বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে যারা ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থায়ন নিয়ে গবেষণা করেন তারা গ্রাহকের প্রকৃত প্রয়োজন ও চাহিদা সম্পর্কে বাস্তব কারণে যথাযথ ওয়াকিফহাল নন। পেশাদার ব্যাংকারদের অগ্রাধিকার এবং বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের মনোভঙ্গীর মধ্যে ইসলামী সীমারেখার আওতায় কার্যকর সমন্বয় প্রতিষ্ঠা একটি জরুরি বিষয়।
নিয়ন্ত্রণকারী পরিবেশ
পৃথিবীর অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংক এমন পরিবেশের মধ্যে কাজ করছে যেখানে জনগণের মধ্যে ইসলামের ব্যাপারে প্রবল আবেগ রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ সরকার ও প্রশাসনের মাঝে শরীয়াহ বিষয়ে আগ্রহ কম।
ফলে ব্যাংকিং পদ্ধতিকে ক্রমশ ইসলামীকরণের ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাব দেখা যায়। বিভিন্ন মুসলিম দেশের সরকারী কর্তৃপক্ষ ইসলামী দেশসমূহের আন্তর্জাতিক ফোরামে বারবার এজন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেও নিজ নিজ দেশে সে ব্যাপারে তাদের কার্যকর উদ্যোগ অনেক ক্ষেত্রে সীমিত বা অনুপস্থিত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে নিয়মনীতি ও আইনের মাধ্যমে দেশের সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও তদারক করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই অভিন্ন নিয়ম-কানুনের মাধ্যমেই (স্বল্প ব্যতিক্রম বাদে ) ইসলামী ব্যাংকসমূহকেও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ইসলামী ব্যাংকের স্বতন্ত্র কর্মধারার সাথে এ অভিন্ন নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই সামঞ্জস্যশীল নয়।
ইসলামী ব্যাংক এমন এক পরিবেশে অস্তিত্ব লাভ করেছে, যেখানে সকল আইন-কানুন, প্রথা-প্রতিষ্ঠান, প্রশিক্ষণ ও দৃষ্টিভঙ্গী সুদভিত্তিক অর্থনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম প্রচলিত দেওয়ানী আইন-কানুনের সাথেও সকল ক্ষেত্রে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
তাই ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলো কোন অসুবিধার সম্মুখীন হলে দেশের দেওয়ানী আদালত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রত্যক্ষ আইনগত ভিত্তি না থাকার কারণে এবং শরীয়ার ব্যাপারে বিচারকদের অনেকেরই প্রয়োজনীয় জ্ঞান না থাকায় উপযুক্ত সমাধান দিতে সমস্যার সম্মুখীন হয়।
সম্পদ ব্যবস্থাপনা
সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে সম্ভাব্য ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার আলোকে ঢেলে সাজাতে ইসলামী ব্যাংকসমূহ অনেক সময় অসুবিধার সম্মুখীন হয় । তারা সবসময় স্বাধীনভাবে তাদের কাঙ্ক্ষিত ব্যবসাটি নির্বাচিত করতে পারে না।
ফলে তাদের কার্যক্রম নিজস্ব চাহিদা মাফিক হয় না। প্রচলিত অর্থনৈতিক কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করা এবং গ্রাহক নির্বাচনের ব্যাপারে পর্যাপ্ত দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে ক্রমশ এক্ষেত্রে ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে।
স্বল্পমেয়াদী কিছু তহবিল তাদের মেয়াদপূর্তির পূর্বে উঠানো হয় না । তাই ব্যাংকারগণ সাধারণত এ তহবিলকে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পে বিনিয়োগ করে থাকেন ।
মেয়াদপূর্তির আগেই অপ্রত্যাশিতভাবে এ তহবিল উত্তোলিত হলে প্রচলিত ব্যাংক সাধারণত বাইরের কোন উৎস হতে নগদ অর্থ সংগ্রহ করতে পারে । কিন্তু সুদমুক্ত ইসলামী অর্থ ও মূলধন বাজার না থাকায় আকস্মিক জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ইসলামী ব্যাংকগুলো বাইরের কোন উৎস হতে নগদ অর্থ সংগ্রহ করতে পারে না।
ইসলামী পদ্ধতিতে আর্থিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ছাড়া এরূপ ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থায় ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে।
তারল্য ব্যবস্থাপনা
‘ট্রেজারি বিল’ এবং অর্থবাজারে প্রচলিত অন্যান্য ‘সিকিউরিটি ইনস্ট্রুমেন্ট’ ব্যবহার করে সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলো তাদের তারল্য (Liquidity) সংকট এড়াতে পারে।
আবার অতিরিক্ত তারল্য কমানোর ক্ষেত্রেও তারা এসব ইনস্ট্রুমেন্ট কাজে লাগাতে পারে। ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের তারল্য সংকটে সুদভিত্তিক এ ধরনের ইনস্ট্রুমেন্টের সহযোগিতা নিতে পারছে না। এর জন্য বিকল্প ব্যবস্থা প্রয়োজন।
ইসলামী ব্যাংকের তারল্য সংক্রান্ত প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে পাকিস্তানে Participation Term Certificate (PTC) ૩ Mudaraba Certificate এবং মালয়েশিয়ায় Government Investment Certificate (GIC) চালু করা হয়েছে। অন্যান্য দেশেও এরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
অগ্রাধিকার খাত নির্ধারণে ব্যর্থতা
সমাজের অগ্রাধিকারভিত্তিক খাতে ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারণে ইসলামী ব্যাংকসমূহের উদ্যোগ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এখনো আশানুরূপ নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, ট্রাস্ট ও ইয়াতীমখানা ইত্যাদিসহ বহু সামাজিক খাত এখনো ইসলামী ব্যাংকসমূহের অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়নি।
উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার
উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিশ্বজুড়ে ব্যাংকিং জগতের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবেশে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে উন্নত পদ্ধতি ও নতুন নতুন প্রোডাক্টের উদ্ভাবন ঘটানো হয়েছে। কিন্তু এ পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য অনেক ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রমে এখনো প্রতিফলিত হয়নি।
উন্নত প্রযুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে ইসলামী ব্যাংকসমূহকে এ ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে এবং আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ব্যবস্থাপনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্রক্রিয়াকে পুনর্বিন্যাস করার মাধ্যমে মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে হবে। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ প্রয়োগ ছাড়া ইসলামী ব্যাংকসমূহ তাদের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে পারবে না।
প্রচার কার্যক্রম ও মিডিয়ার ব্যবহার
ইসলামী ব্যাংকসমূহ এখনও প্রচারের ক্ষেত্রে মিডিয়ার সাফল্যজনক ব্যবহারে অনেক পিছিয়ে আছে। দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার কার্যক্রম, এর স্বতন্ত্র নীতি, পদ্ধতি, কর্মকৌশল এবং এর সফলতার নানা দিক সম্পর্কে এখনো অধিকাংশ মুসলমানই অবগত নন।
ইসলামী ব্যাংকসমূহ তাদের কার্যক্রমকে গণমুখী করার জন্য মিডিয়াকে কাজে লাগাতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থার উন্নততর পদ্ধতি অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে যে ইতিবাচক অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছে এ ক্ষেত্রেও তাদের তেমন কোন প্রচার নেই।
ইসলামী ব্যাংকিং-এর ধারণাগত ও প্রায়োগিক শ্রেষ্ঠত্বকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা ইসলামী ব্যাংকগুলোর এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বড় রকমের ঘাটতি বিদ্যমান। ইসলামী ব্যাংকিং-এর সাথে সংশ্লিষ্ট মহলকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ বিষয়ে তৎপর হওয়া উচিত।
আরো পড়ুন: ইসলামী ব্যাংকিং: সমালোচনা ও বাস্তবতা