ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী সম্পর্কে জানুন

পৃথিবীতে ইসলামী অর্থনীতি যাদের হাত ধরে এসেছিল তাদের নিয়েই আজকের আয়োজন। এই পাঠে জানার চেষ্টা করবো ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী সম্পর্কে। যারা নিরলস সাধনার মাধ্যমে পৃথিবীতে ইসলামী ব্যাংকিং ও ইসলামী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার নিয়মিত আয়োজনের অংশ হিসেবে পূর্বে আমরা জেনেছিলাম ইসলামী সভ্যতায় ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক চিন্তা নিয়ে। তার ধারাবাহিকতায় ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী সম্পর্কে আজকে জানবো।

সরকারী ব্যয়, গার্হস্থ্য অর্থনীতি, বিনিময় বাণিজ্য, কর, শ্রম বিভাজন, একচেটিয়াবাদ, মূল্য নিয়ন্ত্রণ তথা অর্থ-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁদের অবদান সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিশ্ববাসীকে পথ দেখিয়েছে। আজকে ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী সম্পর্কে জানুন;

Advertisement

তাঁদের চেষ্টা ও অবদান পদ্ধতিগত অর্থনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে হাজার বছরের একটি অব্যাহত ধারা রচনা করেছে। অন্যকোন সভ্যতায় অর্থনৈতিক চিন্তার এমন ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা দেখা যায় না।

Table of Contents

ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার দিশারীগণ

ইসলামী অর্থব্যবস্থার কল্যাণধর্মী আদর্শের ভিত্তিতে জনগণকে অর্থনৈতিক জীবন পরিচালনায় পথ দেখাতে ইসলামের প্রথম পর্যায়ের সাহাবীগণ ছাড়াও আব্বাসীয় যুগের বিশিষ্ট দার্শনিক ও চিন্তাবিদগণ অমূল্য অবদান রেখেছেন।

Advertisement

এখানে কয়েকজন পূর্বসূরী চিন্তাবিদ সম্পর্কে অতিসংক্ষেপে কিছুটা ধারণা পেশ করা হলো:

  • ইমাম আবূ ইউসুফ (৭৩১-৭৯৮ খ্রি.),
  • আল-শায়বানী (৭৫০-৮০৪ খ্রি.),
  • আবূ উবাইদ (৭৬৬-৮৩৮ খ্রি.),
  • ইয়াহ্ইয়া ইবনে আদম (৭৫২-৮১৮ খ্রি.),
  • আল-মুহাসিবী (৭৮১-৮৫৭ খ্রি.)
  • কুদামা বিন জাফর (মৃত্যু ৯৪৮ খ্রি.),
  • ইব্‌ন আল মুক্বাফ্ফা,
  • আল যাহির,
  • আল মাওয়ার্দী (৯৭৪-১০৫৮ খ্রি.),
  • ইবনে হাযম (৯৯৪-১০৬৪ খ্রি.),
  • আল ফারাবী (৯৫০ খ্রি.),
  • আল হারীর (১০৫৪-১১২২ খ্রি.),
  • গায্যালী (১০৫৫-১১১১ খ্রি.),
  • নাসিরুদ্দীন তূসী (১২০১- ১২৭৪ খ্রি.),
  • ইবনে তাইমিয়া (১২৬২-১৩২৮ খ্রি.),
  • ইবনুল কাইয়্যিম (১২৯২- ১৩৫০ খ্রি.),
  • আল শাতিবী (মৃত্যু ১৩৮৮ খ্রি.),
  • আল-দিমাশকী,
  • ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬ খ্রি.),
  • আহমাদ আলী আল-দালাযী (মৃত্যু ১৪২১ খ্রি.)
  • শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (১৭০৩-১৭৬৩ খ্রি.)

ইসলামী চিন্তা, দর্শন ও মনীষার ক্ষেত্রে বিরাট সংখ্যক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক অর্থনৈতিক চিন্তার বিভিন্ন শাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন উপরোক্ত ইসলামী অর্থনীতি চিন্তাবিদগণ।

Advertisement

আবূ ইউসুফ ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার দিশারী

ইমাম আবূ হানিফা (র)-এর যোগ্য ছাত্র বাগদাদের প্রধান বিচারপতি ইমাম আবূ ইউসুফ (৭৩১-৭৯৮ খ্রি.) ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম।

কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে অর্থনৈতিক বিধান রচনার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর ‘কিতাবুল-খারাজ’ বিধিবদ্ধ অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটি সুপ্রাচীন মূল্যবান দলিল। সামষ্টিক অর্থনীতিতে (Macro Economics) তিনি সবচে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

আবূ ইউসুফ (র) জনগণের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ, কর আরোপ ও আদায়ের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও সমতা রক্ষা, কৃষি উন্নয়ন এবং কৃষি ভূমির ওপর কর আরোপের ব্যাপারে মূল্যবান সুপারিশ পেশ করেন।

তিনি সবচে মৌলিক অবদান রেখেছেন সরকারী অর্থায়নের ক্ষেত্রে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ বিষয়েও তাঁর আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। কিভাবে মূল্য নির্ধারিত হয়, মূল্যের উপর কর কিরূপ প্রভাব ফেলে এসব বিষয় তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন ।

Advertisement

ইমাম আবূ ইউসুফের অর্থনৈতিক চিন্তা পরবর্তীকালের ইসলামী গবেষকদের জন্য আলোকবর্তিকা হিসেবে পথ দেখিয়েছে; (ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী)

আল-শায়বানী (ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী)

ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান আল-শায়বানী (৭৫০-৮০৪ খ্রি.) তাঁর গ্রন্থ ‘কিতাবুল-ইকতিসাব ফির্-রিক আল-মুসতাতব’-এ সৎ উপার্জন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ইজারাহ্ (ভাড়া), তিজারাহ্ (ব্যবসা), যিরা আহ্ (কৃষি) এবং সিনা’আহ্ (শিল্প) প্রভৃতি সম্পর্কে তাঁর পদ্ধতিগত আলোচনা ও সুপারিশ গুরুত্বপূর্ণ।

শায়বানী মনে করেন, একজন মুসলিম তার আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে জনকল্যাণের নীতি অনুসরণ করবেন। তিনি হবেন অমুখাপেক্ষী। তিনি পরমুখাপেক্ষী হবেন না।

ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার দিশারী শায়বানীর মতে, কৃষিকাজই সর্বোত্তম পেশা। সমাজের জন্য এটি সবচে অপরিহার্য ও কল্যাণধর্মী। এই কারণে সমকালীন ইমাম ও ফকীহদের মধ্যে তিনি মৌলিকত্বের দাবিদার।

Advertisement

শায়বানী লোকদেরকে সংসারত্যাগী না হয়ে নিজ সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্য যতটুকু প্রয়োজন কমপক্ষে ততটুকু আয় করার জন্য চেষ্টা চালানোর পরামর্শ দিয়েছেন।

তিনি তাঁর ‘কিতাবুল-আসল’ নামক গ্রন্থে এবং অন্যান্য রচনায় সালাম (অগ্রিম ক্রয়), শিরকাত শিরকাত (অংশীদারিত্ব) ও মুদারাবাহ (মুনাফায় অংশীদারিত্ব) ইত্যাদি লেনদেন সম্পর্কে মূল্যবান আলোকপাত করেন।

আবূ উবাইদ

আবূ উবাইদ আল-কাসিম ইবনে সাল্লাম (৭৬৬-৮৩৮ খ্রি.) তাঁর কিতাবুল আমওয়াল’ নামক বইতে রাষ্ট্রের নাগরিক ও শাসকের মধ্যে সম্পর্ক নিরূপণ করেন।

তিনি শাসক ও জনগণের পরস্পরের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে মূল্যবান আলোচনা করেন। তিনি যাকাত, উশর, খুমস্, ফাই (খারাজ ও জিযিয়া) ইত্যাদি সম্পর্কেও বিস্তারিত আলোচনা ও বিশ্লেষণ পেশ করেছেন। ইসলামের প্রথম দু’শতাব্দীর অর্থনৈতিক ইতিহাস হিসেবে তাঁর গ্রন্থ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

আল-মুহাসিবী

আবূ আবদিল্লাহ হারিস ইবনে আসাদ আল-আনাযী আল-মুহাসিবী (৭৮১-৮৫৭ খ্রি.) ভোগ ও ব্যবহারে শরীয়াহ্ পরিপন্থী সব কিছু বর্জন করার আহ্বান জানান। জীবন যাপনে তিনি যুহদ বা মিতাচারী হতে বলেন।

কারণ, তাঁর মতে ভোগের লালসা মানুষের মধ্যে হালালের সীমালঙ্ঘনের আশংকা সৃষ্টি করে । তাঁর মতে, ব্যক্তির সাথে সম্পদের সম্পর্ক হবে নিয়ন্ত্রিত ও সতর্কতামূলক।

এ ধরনের সম্পর্ক স্থাপনকে তিনি উৎসাহিত করেছেন। তিনি ভোগের লালসা পরিহার ও সম্পদ ব্যবহারে স্বার্থপরতা ত্যাগ করার পরামর্শ দেন।

তাঁর মতে, কর্জে হাসান ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করার মাধ্যমে সমাজে পারস্পরিক সহযোগিতার বিস্তার ঘটাতে হবে। এভাবেই একটি দায়িত্বশীল দরদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।

আল মুহাসিবী তাঁর ‘রিসালাহ আল-মাকাসিব ওয়াল ওয়ারা শুবুহাহ’ নামক গ্রন্থে এসব মৌলিক বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

আল-মাওয়ার্দী (ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার দিশারী)

আবুল হাসান আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবন হাবীব আল-বসরী আল-বাগদাদী আল-মাওয়ার্দী (৯৭৪-১০৫৮ খ্রি.) ইরাকের বসরায় জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের দীর্ঘ সময় তিনি বাগদাদে অবস্থান করেন।

তিনি বাগদাদের প্রধান বিচারপতির দায়িত্বও পালন করেন। শাসকের কর্তব্য, সরকারী আয় ও ব্যয়, সরকারী জমি, খাস জমি ইত্যাদি বিষয়ে তিনি তাঁর ‘আল-আহকামুল-সুলতানিয়া’ নামক গ্রন্থে মূল্যবান আলোচনা করেছেন।

তাঁর মতে, একজন আদর্শ শাসকের দায়িত্ব হবে:

১. বাজার তদারকি করা;

২. সঠিক ওজন নিশ্চিত করা;

৩. প্রতারণা রোধ করা;

৪. ব্যবসায়ী ও কারিগরদের লেনদেনে শরীয়াহর নিয়ম-কানুনের অনুসরণ নিশ্চিত করা।

অর্থনৈতিক আচরণ সম্পর্কে তিনি তাঁর কিতাব আদার দীন ওয়াদ্ দুনিয়া’ নামক গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তাঁর মতে, সৎ উপার্জনের চারটি প্রধান উপায় হলো কৃষিকাজ, পশু পালন, ব্যবসা ও শিল্প।

ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার দিশারী ইবনে হাযম

আবূ মুহাম্মদ আলী ইবনে আবূ উমর আহমদ ইবনে সাঈদ ইবনে হাযম আল- কুরতুবী আল-আন্দালুসী (৯৯৪-১০৬৪ খ্রি.) স্পেনের কর্ডোভায় জন্মগ্রহণ করেন। 

তাঁর রচনার মধ্যে ‘আল-মুহাল্লি শারহ আলা মিনহাজিত্ তালিবীন’ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মৌলিক চাহিদা ও অভাব, ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা, কর ও যাকাত প্রভৃতি বিষয় তাঁর রচনায় প্রাধান্য পেয়েছে। ইমাম ইবনে হাযম সম্পদহীন মানুষের অভাব দূর করতে বিত্তবান লোকদের ভূমিকার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন; (ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী)

তাঁর মতে, গরীব মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্ব ধনীদের নিতে হবে। এ দায়িত্ব ধনীরা এড়িয়ে যেতে চাইলে তাদের সম্পদের অংশ এই কাজে ব্যয় করতে বাধ্য করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ভূমিস্বত্ব এবং কৃষি অর্থনীতি সম্পর্কে তাঁর আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কর আদায় পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি মূল্যবান আলোচনা করেছেন। 

পীড়ন ও শোষণমূলক বা জবরদস্তি কর আরোপ ও আদায়ের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন। তাঁর মতে যাকাত আদায়ের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কেউ যাকাত পরিশোধ না করে মারা গেলে তার সম্পদ হতে রাষ্ট্রকে যাকাত আদায় করতে হবে বলেও তিনি মত দিয়েছেন।

আল-গায্যালী

আবূ হামিদ মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মদ আল-তুসী আশ-শাফিঈ আল-গায্যালী (১০৫৫-১১১১ খ্রি.) এ উপমহাদেশে মূলত একজন ইসলামী দার্শনিক হিসেবে পরিচিত। ‘ইহ্‌ইয়্যা উলুমিদ্দীন’ তাঁর, অবিস্মরণীয় ও কালজয়ী গ্রন্থ।

তাঁর অর্থনৈতিক চিন্তাও অত্যন্ত মূল্যবান । তিনি বলেন, একজন ব্যবসায়ী এমনভাবে তার দায়িত্ব পালন করবেন যাতে তার সামাজিক বাধ্যতামূলক কর্তব্য বা ‘ফরয-ই-কিফায়া’ পালিত হয়।

গায্যালী বলেন, শরীয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে তাদের আক্বীদা-বিশ্বাস, জীবন, বুদ্ধিবৃত্তি, সন্তান-সন্ততি ও সম্পদের সংরক্ষণ করা। তাঁর মতে, যা কিছু এই পাঁচটি বিষয়ের সংরক্ষণের নিশ্চয়তা বিধান করে তা-ই জনস্বার্থ বলে গণ্য এবং সেটাই কাম্য।

তাঁর মতে, সাধারণভাবে খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের জন্য যতটুকু আয় করা দরকার, তারচে’ বেশি বা কম আয় করার চেষ্টা করা উচিত নয়। ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজনের মধ্যে থাকবে আসবাবপত্র, বিয়ে ও সন্তান পালন আর কিছু সম্পত্তি।

রাসূল ও তাঁর সাহাবীগণের জীবনধারাই ছিলো গায্যালীর কাছে আদর্শ । তাঁর মতে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত উপার্জন করে তা মজুদ রাখা, গরীব ভাইদের সহায়তা না করা যুলুমের নামান্তর।

ইমাম গায্যালী নাগরিকদের সাহায্য করা, তাদের প্রয়োজনের দিকে নযর দেওয়া, দুর্নীতি বন্ধ করা এবং শরীয়াহ্বিরোধী কর আরোপ না করার জন্য শাসকদেরকে পরামর্শ দিয়েছেন। জনগণ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হলে খাদ্য-বস্ত্র ছাড়াও সরকারী কোষাগার হতে আর্থিক সাহায্য দেয়ার জন্যও তিনি সরকারকে তাকীদ দেন।

শ্রম বিভাগ ও মুদ্রার ক্রমবিকাশে গায্যালীর অবদান মূল্যবান। ‘রিবা আল- ফদল’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি মুদ্রার প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। তিনি যুক্তি দেখান যে, মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করার জন্য। মুদ্রা গচ্ছিত রাখার ফলে সেই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।

নাসিরউদ্দীন তূসী

নাসিরউদ্দীন তূসী (১২০১-১২৭৪ খ্রি.) তাঁর ‘রিসালা-ই-মালিয়াত’ গ্রন্থে করের বোঝা কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। শরীয়ার অনুমোদন নেই এমনসব করের তিনি বিরোধিতা করেন। পেশা হিসেবে কৃষি তাঁর বিবেচনায় সবচে’ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসা ও অন্যান্য পেশার অবদান সে তুলনায় কম।

তাঁর মতে, উন্নয়নের জন্য সঞ্চয়ের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি স্বর্ণালঙ্কার ও আবাদযোগ্য জমি কেনার বিরোধিতা করেছেন। 

তিনি তাঁর বিভিন্ন রচনায় আড়ম্বরপূর্ণ ভোগব্যয় তথা বস্তুবাদী ও ভোগবাদী জীবনধারার কঠোর সমালোচনা করেছেন। সঠিক অর্থনৈতিক ভিত্তি অর্জন ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করার মধ্যেই জনগণের সমৃদ্ধি এবং শাসকদের সাফল্য নিহিত বলে তিনি মনে করেন ।

ইবনে তাইমিয়া

তাকীউদ্দীন আবূ আব্বাস আহমদ ইবনে আবদুল হালিম ইবনে আবদুস সালাম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে তাইমিয়া আল-হাররানী আল-হাম্বলী (১২৬২-১৩২৮ খ্রি.) ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত মুজাদ্দিদ বা যুগস্রষ্টা সংস্কারক। 

ইবনে তাইমিয়ার চিন্তা ও কাজের প্রভাব তেরো ও চৌদ্দ শতকের তাঁর সময়কে অতিক্রম করে দুনিয়ার জ্ঞানের পরিসরকে আজো আলোকিত করে চলেছে। 

বর্তমান বিশ্ব যে অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্য অ্যাডাম স্মীথের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে৷ অনেকের মতে অ্যাডাম স্মীথের পাঁচশ’ বছর পূর্বেই ইমাম ইবনে তাইমিয়া সে সম্পর্কে ধারণা পেশ করেছেন।

ইবনে তাইমিয়ার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল সমাজ। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বই আল-হিসবাহ ফিল ইসলাম’। এ গ্রন্থে তিনি চুক্তি ও তার বাস্তবায়ন, দাম ও ন্যায্য দাম, বাজার তদারকী, সরকারী অর্থব্যবস্থা, জনগণের প্রয়োজন পূরণে সরকারের ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে মূল্যবান আলোচনা করেছেন।

তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার এবং জবাবদিহির অনুভূতিহীন জাগতিক কাজকর্মে লিপ্ত ব্যক্তিদের নিন্দা করেছেন। সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করার উপায় হিসেবে তিনি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সীমানা চিহ্নিত করেন। তাঁর মতে, একটি সমাজ নিয়মের মধ্যে চললে সেখানে অনৈতিক কাজ বন্ধ হবে।

ইবনে তাইমিয়া অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পূর্ণ স্বাধীনতার সুরক্ষা এবং ব্যক্তিগত সম্পদ নৈতিকভাবে ব্যবহারের তাকীদ দিয়েছেন। তিনি লেনদেনের সকল চুক্তি ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে সম্পাদনের পরামর্শ দেন। 

চুক্তিবদ্ধ অংশীদারগণ স্বেচ্ছায় সব শর্ত মেনে চলবেন। এ ক্ষেত্রে কোন রকম জোর- যুলুম বা জবরদস্তি থাকবে না। এরূপ নীতি মেনে চললেই বাজারদর ন্যায্য হবে এবং বাজারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। 

ন্যায্য বাজার-দামের ওপর ইবনে তাইমিয়াই প্রথম বিস্তারিত আলোকপাত করেন। তিনি বিভিন্ন ধরনের অংশীদারিত্ব সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন।

অর্থনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার দৃষ্টিভঙ্গির কয়েকটি বিষয়ঃ

১ . নাগরিকদের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য। বায়তুল মাল হতেই এই উদ্যোগ নিতে হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ ছাড়া বেকারত্ব দূর হবে না। এজন্য সরকারকে কর্মসূচী নিতে হবে।

২. রাষ্ট্র যাকাত আদায় করবে। আদায়কৃত যাকাত এবং কর ও শুল্ক থেকে জনগণের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ না হলে সরকার ধনীদের ওপর আরো কর আরোপ করবে। তাতেও ব্যয় সংকুলান না হলে তাদের কাছ থেকে ঋণ নেবে।

তারপরও ঘাটতি থেকে গেলে ধনীদের উদ্বৃত্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করবে। সূরা আল-জারিয়া ১৯তম আয়াতে আল্লাহ তাআলা সরকারকে এই অধিকার দিয়েছেন।

৩. রাষ্ট্র তার নাগরিকদের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করতে পারবে কি-না, কোন্ অবস্থায় কতটুকু হস্তক্ষেপ প্রয়োজন, তার সীমা সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেছেন।

৪. বাজার তদারকি তথা ভোক্তার জন্য মূল্যনিয়ন্ত্রণ এবং সেইসাথে ব্যবসায়ীর ন্যায্য মুনাফা নিশ্চিত করা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বাজারে ন্যায়সঙ্গত প্রতিযোগিতা বজায় রাখার দায়িত্বও সরকারের। জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে মূল্যনিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মুনাফাখোরী বন্ধ করতে হবে। সেইসাথে ব্যবসায়ীদের ন্যায্য মুনাফার দিকেও নযর রাখতে হবে।

৫. বিশেষ অবস্থায় সরকার জনস্বার্থে ব্যক্তির কোন কোন অধিকার খর্ব বা বাতিল করারও এখতিয়ার রাখে।

৬. প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘আল-হিসবাহ’র ধারণা অর্থনীতির ইতিহাসে ইবনে তাইমিয়ার মৌলিক চিন্তার ফসল। একচেটিয়া কারবার, মজুদদারী, মুনাফাখোরী, ফটকাবাজারী, ওজনে কারচুপি প্রভৃতি জনস্বার্থবিরোধী কাজ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ‘আল-হিসবাহ’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

‘আল- হিসবাহ’ প্রতিষ্ঠান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে অপরিহার্য দ্রব্যসামগ্রীর যোগান নিশ্চিত করবে, শিল্প, ব্যবসা ও অন্যান্য সেবা তদারকি করবে, দ্রব্যের মান ও পরিমাপ যাচাই করবে এবং মজুদদারী, মুনাফাখোরী, জুয়া ও সুদের কারবারসহ অর্থনৈতিক অপরাধসমূহ দমন করবে।

৭. ইবনে তাইমিয়া সম্পদের মালিকানার ধারণা সম্পর্কেও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

ইবনুল কাইয়্যিম

শামসউদ্দীন আবূ আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আবূ বকর ইবনুল কাইয়্যিম (১২৯২-১৩৫০ খ্রি.)-এর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-তুরুক্ আল-হুকমিয়্যাহ’।

তিনি ন্যায়সঙ্গত মূল্য, যুক্তিসঙ্গত ক্ষতিপূরণ, উপযুক্ত মজুরি এবং সঙ্গত মুনাফার প্রবক্তা ছিলেন। একচেটিয়া কারবার অথবা দুর্বল বাজার-ব্যবস্থাপনা মুকাবিলা করার উপায় নিয়ে তিনি আলোচনা করেন।

বাজারদর নিয়ন্ত্রণের একটি নীতিমালাও তিনি পেশ করেন। ইবনে তাইমিয়ার মতো তিনিও প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘হিসবাহ’ সংস্থার সমর্থক ছিলেন।

তাঁর মতে, শরীয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের জ্ঞানগত উৎকর্ষ সাধন এবং তার ইহজাগতিক ও পরকালীন কল্যাণ সাধন। সার্বিক ন্যায়বিচার, দয়া, সমৃদ্ধি ও জ্ঞানের মধ্যে এই কল্যাণ নিহিত।

কোন সমাজে ন্যায়বিচারের পরিবর্তে যুলুম, দয়ার পরিবর্তে কঠোরতা, কল্যাণের পরিবর্তে কার্পণ্য আর জ্ঞানের বদলে মূর্খতা প্রবল হলে সেখানে শরীয়ার উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।

তাঁর অর্থনীতি-চিন্তার প্রধান লক্ষ্য ছিলো:

১. সুবিচার (আদল) প্রতিষ্ঠা করা;

২. জনস্বার্থ (আল-মাসলাহা আল-আম্‌মাহ) সংরক্ষণ করা;

৩. জনস্বার্থ ও সুবিচারবিরোধী কাজ (সাদ আল-যারি আহ) প্রতিহত করা;

তাঁর মতে, ব্যক্তি তার সম্পদ বৃহত্তর সমাজের স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলে রাষ্ট্র অবশ্যই তাতে হস্তক্ষেপ করবে।

আল-শাতিবী

আবূ ইসহাক আল-শাতিবীর (মৃত্যু ১৩৮৮ খ্রি.) সর্বাধিক আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘আল-মুওয়াফাক্বাত ফি উসুল আল-শারী’আহ’। শরীয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য (মাক্কাসিদ আল-শরীয়াহ) কিভাবে হাসিল হবে, তার পদ্ধতি ও কর্ম- কৌশল সম্পর্কে তিনি মূল্যবান আলোচনা করেছেন।

শরীয়ার উদ্দেশ্য বাস্ত বায়নের দৃষ্টিতেই তিনি রাষ্ট্রের ভূমিকা নিরূপণ করেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের জন্য সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকারমূলক চারটি কাজ হলো :

১. যাকাত প্রতিষ্ঠা করা,

২. জীবনের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পূরণ করা,

৩. সম্পত্তি সংরক্ষণ, সম্পদের অপচয় রোধ ও অন্যের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করা থেকে বিরত রাখা,

8. নেশা জাতীয় যাবতীয় উপকরণ এবং বিচারবোধ বিনষ্টকারী সব দ্রব্যের উৎপাদন, বিপণন ও ভোগ নিষিদ্ধ করা।

ইমাম শাতিবী মানুষের চাহিদা বা প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার অনুযায়ী তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করেন:

১. অপরিহার্য (যরূরিয়াত)

২. প্রয়োজনীয় (হাজিয়াত) 

৩. উৎকর্ষমূলক (তাহসিনিয়াত)

ইমাম শাতিবীর মতে, সকল নাগরিকের জরুরি বা অত্যাবশ্যকীয় পাঁচটি চাহিদা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারমূলক দায়িত্ব।

মানুষের এই পাঁচটি মৌলিক প্রয়োজন নিশ্চিত ও হিফাযত করার মধ্যেই পার্থিব জীবনের শান্তি ও সফলতা এবং আখিরাতের মুক্তি ও কল্যাণ নিহিত। এই পাঁচটি মৌলিক চাহিদা ও অধিকার হলো:

১. বিশ্বাস (আল-দ্বীন)-এর সংরক্ষণ,

২. জীবন (আল-নফস)-এর সংরক্ষণ,

৩. বংশধর (আল-নসল)-এর সংরক্ষণ,

৪. সম্পত্তি (আল-মাল)-এর সংরক্ষণ,

৫. বুদ্ধিমত্তা (আল-আকূল)-এর সংরক্ষণ;

ইবনে খালদুন

ওয়ালীউদ্দীন আবদুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবূ বকর মুহাম্মদ ইবনুল হাসান ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬ খ্রী.) মূলত একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে বিশ্বখ্যাত।

অর্থনীতি বিষয়ে তাঁর অবদান নিয়ে গবেষণাও বর্তমান যুগের একটি আকর্ষণীয় বিষয়। দীর্ঘকাল পর এখন তাঁকে অনেকেই অর্থনৈতিক চিন্তার অন্যতম আদি পিতা হিসেবে স্বীকার করছেন।

ইবনে খালদুনের সবচে বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল মুকাদ্দিমা’। এই বইতে তিনি-

১. শ্রম বিভাজন,

২. মূল্য পদ্ধতি,

৩. উৎপাদন ও বণ্টন,

৪. মূলধন সংগঠন,

৫. চাহিদা ও যোগান,

৬. মুদ্রা,

৭. জনসংখ্যা,

৮. বাণিজ্যচক্র,

৯. সরকারী অর্থব্যবস্থা,

১০. উন্নয়নের স্তর এবং এমনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয়ে মূল্যবান আলোচনা করেছেন।

শ্রমবিভাজন ও এর ইতিবাচক ফল সম্বন্ধে ইবনে খালদুনের আলোচনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দেখিয়েছেন, একজন গম উৎপাদনকারীকে তার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ছয় থেকে দশ ধরনের সেবা নিতে হয়।

এভাবে অন্যের সেবা নিয়ে নিজ প্রয়োজনের চেয়ে তিনি বেশি উৎপাদন করেন। উদ্বৃত্ত ফসলের বিনিময়ে তিনি অন্য দ্রব্য সংগ্রহ করেন। এভাবেই পরস্পর নির্ভরতার মধ্য দিয়ে প্রাচুর্য আসে। এই দিক দিয়ে ডেভিড রিকার্ডোর Comparative Advantage. Theory-কে তার সমর্থক মনে হয়।

ইবনে খালদুন বিভিন্ন পেশা সম্পর্কে বলেছেন

ইবনে খালদুন বিভিন্ন পেশা সম্পর্কে এবং এসব পেশার সামাজিক উপযোগিতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। উৎপাদনের সামাজিক সংগঠনে মানবীয় শ্রমের গুরুত্ব তিনি তুলে ধরেছেন। মানবীয় শ্রমব্যবস্থা বর্তমানে একটি অন্যতম আলোচ্য বিষয়।

দারিদ্র্যের ভিত্তি ও তার কারণ নিয়েও তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। এসব কারণে কোন কোন চিন্তাবিদ তাঁকে প্রুধো, মার্কস, এঙ্গেল্স প্রমুখের অগ্রবর্তী ও পূর্বসুরী মনে করেন।

ইবনে খালদুনের মতে, জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে জনসংখ্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জনসংখ্যা বেশি হলে শ্রমবিভাজন ও বিশেষীকরণ সহজ হয়।

এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। ফলে বিলাসদ্রব্যের চাহিদা বাড়ে ও শিল্পে বৈচিত্র্য আসে। তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ মডেলটি পরবর্তীতে অনেকে গ্রহণ করেছেন।

বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকদের দক্ষতার ওপর ভিত্তি করেই শ্রমের আন্তর্জাতিক বিভাজন ঘটে

ইবনে খালদুন মনে করেন, প্রাকৃতিক সম্পদ নয়; বরং বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকদের দক্ষতার ওপর ভিত্তি করেই শ্রমের আন্তর্জাতিক বিভাজন ঘটে। বোলাকিয়ার মতো আধুনিক অর্থবিজ্ঞানীগণ ইবনে খালদুনের এই ধারণার প্রশংসা করেছেন।

তাঁর ‘কিতাব আল-ইবার’ বিশ্ব ইতিহাস সম্পর্কে বিখ্যাত গ্রন্থ । এ গ্রন্থে তিনি রাজবংশের উত্থান-পতনের কার্যকারণ বিশ্লেষণ করেছেন।

দারিদ্র্য ও প্রাচুর্যের ধরন সম্পর্কেও তিনি অন্তর্ভেদী আলোকপাত করেছেন। তিনি রাষ্ট্রসমূহের ধনী কিংবা দরিদ্র হওয়ার কারণ চিহ্নিত করারও চেষ্টা করেছেন।

ইবনে খালদুন ধনী ও গরীব দেশগুলোর মধ্যে বিনিময়ের হার, আমদানি ও রফতানির প্রবণতা, উন্নয়নের ওপর অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রভাব প্রভৃতি বিশ্লেষণ করে বহু গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এসকল তত্ত্বকে কেউ কেউ আধুনিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যতত্ত্বের আদিসূত্র মনে করেন।

সোনা ও রূপাকে যে অর্থে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন

তিনি সোনা ও রূপাকে যে অর্থে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন এবং তা ব্যবহারের কথা বলেছেন, তার সাথে পরবর্তী যুগের বাণিজ্যবাদীদের চিন্তার মিল দেখা যায়। এ কারণে তাঁকে বাণিজ্যবাদীদের পূর্বসূরী হিসেবেও গণ্য করা হয়।

শ্রমের মূল্যতত্ত্ব সম্পর্কেও তিনি আলোচনা করেছেন। কারো কারো মতে ইবনে খালদুনের শ্রমের মূল্যতত্ত্বে শ্রমিকের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় ভূমিকা স্বীকৃত হয়েছে। কার্ল মার্কস্ অনেক পরে এসে এ বিষয়ে কথা বলেছেন।

এ দিক থেকে তাঁকে মার্কসের পূর্বসূরী বিবেচনা করা যায়। সভেতলানা মনে করেন, অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ইবনে খালদুনই প্রথম মূল্যের রহস্য ভেদ করতে সক্ষম হন।

ইবনে খালদুনের মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরস্পর নির্ভরশীল। ইতিহাস ব্যাখ্যায় অর্থনৈতিক বিষয়সমূহের ওপর তিনিই প্রথম গুরুত্ব দিয়েছেন । এ ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রপথিক।

তাঁর ‘সভ্যতার চক্রতত্ত্ব’-কে স্পেঙ্গলার তুলনা করেছেন জে আর হিসের বাণিজ্য চক্রতত্ত্বের সাথে। কোন কোন আধুনিক অর্থনীতিবিদ ইবনে খালদুনকে কীনসের পূর্বসূরী মনে করেন।

কীনসের বহু শতাব্দী আগে ইবনে খালদুন অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে ও ব্যবসায়ের মন্দা কাটিয়ে উঠতে সরকারী ব্যয়ের প্রয়োজন অনুভব করেন।

কর ও সরকারী ব্যয় সম্পর্কে ইবনে খালদুনের মত হলো, করের পরিমাণ কম হলে জনগণ সভ্যতার সুবিধাদি ভোগ করার সুযোগ পায় । ফলে তারা উৎসাহিত বোধ করে।

এভাবে কম হারের কর সভ্যতার বিকাশে অবদান রাখে। কম হারের কর অর্থনৈতিক প্রাচুর্য আনতে ও করের ভিত্তি প্রসারে সহায়তা করে। ফলে সরকারের আয় বাড়ে। এর বিপরীতে করের উঁচু হার সরকারের আয় কমিয়ে দেয়।

ব্যবসা-বাণিজ্য গতিশীল রাখতে তাই সরকারী ব্যয় বাড়ানো এবং করের হার কমিয়ে রাখা প্রয়োজন। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত Progressive Taxation ধারণায় ইবনে খালদুনের করতত্ত্বের স্পষ্ট প্রভাব প্রতীয়মান হয়।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইবনে খালদুনের মৌলিক অবদান

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইবনে খালদুনের মৌলিক অবদানের প্রতি আধুনিক অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টি প্রথম আকর্ষণ করেন শ্যূমপীটার।

সাম্প্রতিককালে ব্যারি গর্ডন তাঁর ‘ইকনোমিক অ্যানালিসিস বিফোর অ্যাডাম স্মীথ’ নামক গ্রন্থে ইবনে খালদুনের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণী ক্ষমতার কথা গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন।

জে স্পেঙ্গলার, ফ্রাঞ্জ রোজেনথাল, টি বি আরভিং ও বোলাকিয়াসহ বহু ইউরোপীয় গবেষক ইবনে খালদুনের অন্তর্দৃষ্টি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার জন্য তাঁকে আধুনিক অর্থনীতির অন্যতম পুরোধা হিসেবে বিবেচনা করেন।

ইবনে খালদুনকে অর্থবিজ্ঞানের অন্যতম পিতা হিসেবে অভিহিত করে বোলাকিয়া লিখেছেন-

Ibn Khaldun discovered a great number of fundamental economic notions a few centuries before their official birth. He discovered the virtue and necessity of a division of labour before (Adam) Smith and the principle of labour value before (David) Ricardo. He elaborated a theory of population before Malthus and insisted on the role of the state in the economy before Keynes. But much more than that, Ibn Khaldun used these concepts to build a coherent dynamic system in which the economic mechanism inexorably led economic activity to long-term fluctuations….. His name should figure among the fathers of economic science.

অর্থাৎ “অর্থবিজ্ঞানের মৌলিক তত্ত্বের প্রথাসিদ্ধ জন্মের কয়েক শতাব্দী আগে ইবনে খালদুন সেগুলো আবিষ্কার করেন। শ্রমবিভাজনের নীতিগত মান ও এর বাস্তব প্রয়োজন সম্পর্কিত ধারণা তিনি উপস্থাপন করেন (অ্যাডাম) স্মীথেরও আগে।

(ডেভিড) রিকার্ডোর আগেই তিনি শ্রমের মূল্যতত্ত্ব আবিষ্কার করেন। জনসংখ্যা সম্পর্কে বিস্তারিত তত্ত্বগত ধারণা উপস্থাপনে তিনি ম্যালথাসের চাইতে অগ্রণী। কীনসের আগেই তিনি অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করেছেন।

তারচে বড় কথা, ইবনে খালদুন তাঁর এসব তত্ত্বের ভিত্তিতে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল ব্যবস্থার কাঠামো দাঁড় করান, যে ব্যবস্থার অর্থনৈতিক কর্মকৌশল তার অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে দীর্ঘমেয়াদী নমনীয়তার মধ্য দিয়ে অব্যাহতভাবে এগিয়ে নেয়। ইবনে খালদুনের নাম অর্থবিজ্ঞানের জনকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ

শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ দেহলভী (১৭০৩-১৭৬৩ খ্রি.) তাঁর ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে ব্যক্তিগত আচরণ ও সামাজিক সংগঠনের প্রকৃতি সম্পর্কে শরীয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা পেশ করেছেন।

তাঁর মতে, সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের সার্বিক কল্যাণ তাদের পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্যে নিহিত। বিনিময়, চুক্তি, মুনাফা, ভাগ, ভাগচাষ ইত্যাদির মাধ্যমে এই সহযোগিতা বিকশিত হয়।

সুদ ও জুয়ার মতো বিষয়গুলো সমাজে সহযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করে । তাই এগুলো শরীয়াহ্ বিরোধী। জনগণের অজ্ঞতা, লোভ ও আশাকে কাজে লাগিয়ে জুয়া থেকে অর্থ আয় করা হয়। এর সাথে মানবিক সহযোগিতা বা সভ্যতার সম্পর্ক নেই। সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারেও তিনি একই রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

তাঁর মতে, সভ্যতার সুষ্ঠু বিকাশের জন্য মানবিক সহযোগিতার কাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন। এই সহযোগিতার ক্ষেত্র রচনার জন্য সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে আবাদী জমি ভাগ করা উচিত।

মসজিদের মতোই সমস্ত জমি ভ্রমণকারীদের আশ্রয়স্থল

মসজিদের মতোই সমস্ত জমি ভ্রমণকারীদের আশ্রয়স্থল। ‘আগে আসলে আগে পাবে’ নীতির ভিত্তিতে সবাইকে এসব সম্পদে অংশ দিতে হবে। মালিকানার অর্থ হলো সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার।

সরকারী অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর মত হলো, প্রতিটি সভ্য সমাজের জন্য একটি সরকার থাকবে। সরকার দেশরক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার কায়েম ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করবে। জনগণের স্বার্থে ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট ও পুল-ব্রিজ নির্মাণ করবে। এ ধরনের কাজ করার জন্য সরকারকে অবশ্যই সামর্থ্যবানদের ওপর কর আরোপ করতে হবে।

তিনি মনে করেন, বিলাসী জীবন সমাজে ধ্বংস ডেকে আনে। ইমাম শাতিবীর মতো তিনিও মানুষের চাহিদাকে প্রয়োজনীয়, আরামদায়ক ও বিলাসমূলক এই তিনটি ক্রমঅগ্রাধিকারে ভাগ করেন। তিনি বলেন, একশ্রেণীর লোকের বিলাস ও ভোগের চাহিদা মিটাতে পৃথিবীর সম্পদ বিলাসদ্রব্য উৎপাদনে ব্যবহার করার ফলে সাধারণ মানুষের চাহিদা উপেক্ষিত হয়।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ ভারতবর্ষে দশ জন মুঘল শাসকের শাসনকাল প্রত্যক্ষ করেন। মুঘল শাসনের পতনের জন্য তিনি প্রধান দু’টি বিষয়কে দায়ী করেন। প্রথমত অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যয় এবং দ্বিতীয়ত চাষী, ব্যবসায়ী ও কারিগরদের ওপর উঁচুহারে কর আরোপ।

তিনি ছিলেন সমকালীনতার প্রভাবমুক্ত একজন যুগোত্তীর্ণ চিন্তানায়ক। এই মনীষী সমসাময়িক মতবাদ সমূহের বিভ্রান্তির ঊর্ধে থেকে নিজের মুক্ত চিন্তা ও বিচার-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে উম্মার প্রধান প্রধান দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করেন।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ সমালোচনার মাধ্যমে উম্মার মৌলিক গলদগুলোকে স্পষ্ট করে তোলেন এবং জাতির চিন্তার পুনর্গঠনে তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করেন।

মুসলমানদের পতনের কারণ

তিনি উপলব্ধি করেন যে, ইসলামের মূল সত্য থেকে বিচ্যুতিই মুসলমানদের পতনের কারণ। তিনি ইসলামী আদর্শ, ভাবধারা ও জীবনবিধানের ভিত্তিতে মুসলিম সমাজ পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করেন।

মুসলিম শাসক, আমীর-ওমরাহ, সৈনিক, আলিম, সূফী, ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী তথা সকল স্তর ও পেশার মানুষকে তিনি ইসলামের মূল সত্যের দিকে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানান।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ উপলব্ধি করেন যে, তাঁর সময়েই যুগের একটি স্পষ্ট বিভাজন ঘটছে। তিনিই প্রথম উল্লেখ করেন যে, মধ্যযুগের অবসান হয়েছে এবং আধুনিক যুগের শুরু হতে যাচ্ছে।

এ যুগে শুধু তলোয়ারের মাধ্যমে নয়, কলমের সাহায্যে মুকাবিলার কৌশল প্রয়োগ করতে হবে। তাঁর এ দূরদৃষ্টিই তাঁকে আধুনিক যুগের প্রবক্তা ও একজন সাচ্চা কলম সৈনিক হিসেবে গড়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

তিনি ইসলামী জ্ঞান ও চিন্তার পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়তার ওপর তিনি বিশেষ জোর দেন। ইজতিহাদকে তিনি সকল যুগের জন্য ‘ফরযে কিফায়া’ বলে উল্লেখ করেন। ইজতিহাদের নিয়ম-বিধান ও শর্তাবলী রচনা করে এ ক্ষেত্রে তিনি একটি শৃঙ্খলার পথ-নির্দেশ করেন।

পবিত্র কুরআনের জীবনব্যবস্থা ও ইসলামী জীবনদর্শন

শাহ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে পবিত্র কুরআনের জীবনব্যবস্থা ও ইসলামী জীবনদর্শন সম্পর্কে আলোচনা করেন। ইসলামের নৈতিক, তামুদ্দুনিক ও আইনগত ব্যবস্থাকে তিনি লিখিত আকারে পেশ করার উদ্যোগ নেন।

‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’, ‘ইযালাতুল খিফা’ প্রভৃতি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা ছাড়াও কুরআন-হাদীসের জ্ঞানের সাথে জনগণের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ গড়ে তুলতে তিনি তখনকার সামাজিক ভাষা ফার্সীতে আল-কুরআন তরজমা করেন। পবিত্র কুরআন মজীদের এ তরজমা ছিল সে সময়ের জন্য একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ।

তিনি হাদীসের প্রথম সংকলিত গ্রন্থ ‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’-এর তরজমা করেন এবং তাতে টীকা সংযোজন করেন। এভাবে কুরআন-হাদীসের শিক্ষাপদ্ধতিতে তিনি ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। শাহ ওয়ালীউল্লাহ ও তাঁর সুযোগ্য পুত্রগণের চেষ্টায় ভারতবর্ষে কুরআন ও হাদীসচর্চা ব্যাপকভাবে শুরু হয় ।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ পারিবারিক জীবন সংগঠন (ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী)

শাহ ওয়ালীউল্লাহ পারিবারিক জীবন সংগঠন, সামাজিক রীতি-নীতি, রাজনীতি, বিচার-ব্যবস্থা, কর-ব্যবস্থা, দেশ-শাসন, সামরিক সংগঠন প্রভৃতি দিক নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন।

সমাজ-সভ্যতার বিপর্যয় ও বিকৃতির কারণসমূহের ওপর তিনি গভীরভাবে আলোকপাত করেন। তিনি ইসলাম ও জাহিলিয়াতের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের একটা ধারণাও পেশ করেন এবং খিলাফত ও রাজতন্ত্রের পার্থক্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। জাহিলী রাষ্ট্র ও ইসলামী রাষ্ট্রের পার্থক্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত কোন ঈমানদারের পক্ষেই নিশ্চেষ্ট বসে থাকা সম্ভব নয় ।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ ইসলামকে মূল-ভিত্তিক বিপ্লবী আদর্শরূপেই পেশ করেন। তাঁর মতে, একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ আদর্শ সারা পৃথিবীতে প্রচারিত হওয়া উচিত। এভাবেই তিনি প্যান-ইসলামিক ধারণার বীজও বপন করেন ।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ সমাজ-সভ্যতার বিপর্যয়ের কারণগুলো চিহ্নিত করে ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’য় লিখেছেন:

‘কোন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সভ্যতার বিকাশধারা অব্যাহত থাকলে তাদের শিল্পকলা পূর্ণরূপে বিকশিত হয়। তারপর শাসকগোষ্ঠী ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশ ও ঐশ্বর্যের মোহে আচ্ছন্ন জীবনকে বেছে নিলে সেই আয়েশী জীবনের বোঝা তারা শ্রমিকশ্রেণীর ওপর চাপায়। ফলে সমাজের অধিকাংশ লোক মানবেতর জীবন-যাপনে বাধ্য হয়।

জনগণকে অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে জীবন-যাপনে বাধ্য করলে সমাজ-জীবনের নৈতিক কাঠামো বিপর্যস্ত হয়। মানুষ তখন রুজি-রুটির জন্য পশুর মতো কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য হয় ।

এ চরম নির্যাতন ও অর্থনৈতিক দুর্ভোগ থেকে মানুষকে মুক্ত করতে আল্লাহর পক্ষ থেকে পথের নির্দেশ আসে। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা নিজেই বিপ্লবের আয়োজন করেন।

জনগণের বুকের ওপর থেকে অবৈধ শাসক-চক্রের বোঝা সরানোর ব্যবস্থাও তিনি করেন । রোম ও পারস্যের শাসকরা সে যুলুমবাজির পথেই এগিয়েছিলো। তাদের ঐশ্বর্য ও বিলাসিতার যোগান দিতে গিয়ে জনসাধারণকে পশুর স্তরে নেমে আসতে হয়েছিলো।

এ যুলুমশাহীর প্রতিকারের জন্যই আরবের জনগণের মধ্যে হযরত রাসূলুল্লাহ্ (*)-কে প্রেরণ করা হয়েছিলো। মিসরে ফিরাউন বা ফারাওদের ধ্বংস এবং রোম ও পারস্য সম্রাটের পতন এ নীতি অনুসারে নবুয়াতের আনুষঙ্গিক কর্তব্যরূপে তামিল হয়েছে।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ উপলব্ধি করেন যে, দিল্লীর সম্রাট ও আমীর-ওমরাহ এবং হিন্দুস্তানের অন্যান্য শাসকের নৈতিক দেউলিয়াত্ব পারস্য ও রোমসম্রাটদের কাছাকাছি পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিলো-

শাহ ওয়ালীউল্লাহর বহুমুখী অবদানের কয়েকটি দিক (ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী):

১. শাহ ওয়ালীউল্লাহ ইসলামের ইতিহাস ও মুসলমানদের ইতিহাসের সূক্ষ্ম প্রভেদরেখাটি উম্মার সামনে স্পষ্ট করে তোলে। তিনিই প্রথম এটা দেখান যে, মুসলিম ইতিহাস ও ইসলামের ইতিহাস মূলত এক নয় । 

২. খিলাফত ও রাজতন্ত্রের মধ্যকার নীতিগত ও পারিভাষিক পার্থক্যকে তিনি হাদীসের আলোকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন। সমকালীন রাজতান্ত্রিক সরকারকে তিনি অগ্নিউপাসক সরকারের সাথে তুলনা করে বলেন, এই দুই সরকারের মধ্যে পার্থক্য হলো মুসলিম রাজতন্ত্রী সরকারের লোকেরা নামায পড়ে, মুখে কালেমা উচ্চারণ করে ৷

৩. তিনি জাহিলী রাষ্ট্র ও ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যকার পার্থক্যও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। জাহিলী রাষ্ট্র খতম করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য দায়িত্ব সম্পর্কেও তিনি উম্মাকে সতর্ক ও সচেতন করার চেষ্টা করেন। (ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী)

৪. শাহ ওয়ালীউল্লাহ মাযহাবী অনৈক্যকে সমকালীন মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৌলিক ত্রুটি ও দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, সিরীয় (উমাইয়া) শাসকদের পতনকাল পর্যন্ত কেউ নিজেকে হানাফী বা শাফিয়ী বলে দাবি করতেন না। তারা সকলেই নিজ নিজ ইমাম ও শিক্ষকদের দেখানো পদ্ধতিতে শরীয়তের প্রমাণ গ্রহণ করতেন।

কিন্তু ইরাকী (আব্বাসীয়) শাসকদের সময় থেকে প্রত্যেকেই নিজের জন্য একটি মাযহাবী পরিচয় নির্দিষ্ট করে নেয়। তারা নিজ মাযহাবের বড় বড় নেতাদের অনুমোদন ছাড়া কুরআন ও সুন্নাহর দলিলের ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্ত নিতেও রাজি হতো না।

তুর্কী (ওসমানীয়) শাসনামলে লোকেরা বিভিন্ন দেশে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা নিজ নিজ ফিক্‌হভিত্তিক মাযহাব থেকে যা কিছু স্মরণ করতে পারে, সেটাকেই দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে । আগে যেসব বিষয় কুরআন ও হাদীসের উৎস থেকে উদ্ভূত মাযহাব ছিল, এখন তা-ই স্থায়ী সুন্নতে পরিণত হয়।

৫. শাহ ওয়ালীউল্লাহ ইজতিহাদকে সকল যুগের জন্য ‘ফরযে কিফায়া’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি ইজতিহাদের নিয়ম-নীতি, সংবিধান ও শর্তাবলি সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন। ইজতিহাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের যমানার নির্বোধ ব্যক্তিরা ইজতিহাদের নামে ক্ষেপে ওঠেন এদের নাকে উটের মতো দড়ি বাঁধা আছে। এরা জানেন না যে তারা কোন দিকে যাচ্ছেন।

৬. শাহ ওয়ালীউল্লাহ ইসলামের সমগ্র চিন্তা, নৈতিক ব্যবস্থা, তামুদ্দুনিক ব্যবস্থা ও শরীয়ত লিপিবদ্ধ আকারে পেশ করার চেষ্টা করেন। তিনি তাঁর গ্রন্থসমূহের মাধ্যমে ইসলামী দর্শন লিপিবদ্ধ করার ভিত্তি স্থাপন করেন। নৈতিক দর্শনের ওপর তিনি একটি সমাজ দর্শনের ইমারত নির্মাণ করেন। (ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী)

৭. ভারতের তদানীন্তন সরকারের পরিবর্তে একটি স্বাধীন ইসলামী পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর বিভিন্ন রচনায় দীর্ঘ-মেয়াদী গণ-বিপ্লবের কর্মসূচী পেশ করেন। আল-কুরআনের ফার্সী তরজমা ‘ফতহুর রহমান’-এর টীকাতে তাঁর এই কর্মসূচী অধিকতর স্পষ্টভাবে বিধৃত হয়েছে।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে দু’শ বছর পর সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯ খ্রি.) লিখেছেন: (ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী)

‘একদিকে তাঁর যমানা ও পরিবেশ এবং অন্যদিকে তাঁর অবদান সামনে রাখলে হতবাক হতে হয় যে, সে যুগে এমন গভীর দৃষ্টি, চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের জন্ম কিভাবে সম্ভব হলো! …

সে অন্ধকার যুগে শিক্ষা লাভ করে এমন একজন মুক্ত বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন চিন্তানায়ক ও ভাষ্যকার জনসমক্ষে আবির্ভূত হলেন, যিনি যমানা ও পরিবেশের সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে চিন্তা করেন।

আচ্ছন্ন ও স্থবির জ্ঞান এবং শতাব্দীর জমাটবাধা বিদ্বেষের বন্ধন ছিন্ন করে প্রতিটি জীবন-সমস্যার ওপর গভীর অনুসন্ধানী ও মুজতাহিদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।

তিনি এমন সাহিত্য সৃষ্টি করে যান, যার ভাষা, বর্ণনাভঙ্গি, চিন্তা, আদর্শ, গবেষণালব্ধ বিষয় ও সিদ্ধান্তসমূহের ওপর সমকালীন পরিবেশের কোন ছাপ পড়েনি। (ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী)

এমনকি তাঁর রচনা পাঠ করার সময় মনে এতটুকু সন্দেহেরও উদয় হয় না যে, এগুলো এমন একস্থানে বসে লেখা হয়েছে যার চারদিকে বিলাসিতা, ইন্দ্রিয়পূজা, হত্যা, লুটতরাজ, জুলুম, নির্যাতন, অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার অবাধ রাজত্ব চলছিলো।

মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের ক্রান্তিকালে শাহ ওয়ালীউল্লাহর উচ্চারণ তাঁর শতবর্ষ পরের চিন্তানায়ক কার্ল মার্কসের চাইতেও অধিক বিপ্লবী মনে হয়। কিন্তু জার্মানির ইহুদি পরিবারের সন্তান কার্ল মার্কস কাজ করেছেন তাঁর সময়ের সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র লন্ডনে।

তাঁর চিন্তাকে তিনি সে যুগের সবচে আধুনিক গণমাধ্যমের সাহায্যে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। ফলে দেশে দেশে বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছিল। অন্যদিকে শাহ ওয়ালীউল্লাহ কাজ করেছেন একটি পতনমুখী সভ্যতার রাজধানী দিল্লীতে বসে।

কোন গণমাধ্যম দূরে থাক, তাঁর আশপাশে তাঁর ধারণাকে হজম করার মতো লোকেরও যথেষ্ট অভাব ছিল। এমনকি তাঁর মূল্যবান গ্রন্থসমূহ মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর প্রায় দেড়শ’ বছর পর। (ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী)

শাহ ওয়ালীউল্লাহ আঠারো শতকে ইসলামী চিন্তা-চেতনার বিকাশে যে ভূমিকা পালন করেন, অনেক পরে হলেও তা উপমহাদেশের ইসলামী চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করেছে। উপমহাদেশে ঊনিশ শতকের জিহাদ আন্দোলন, ফরায়েজী আন্দোলন, সিপাহী বিপ্লব, মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ইসলামী জাগরণকে তার চিন্তা পথ দেখিয়েছে।

তারই ধারাবাহিকতায় কুড়ি শতকের মধ্যভাগ থেকে ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তা ও ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার বিকাশে উপমহাদেশের চিন্তাবিদগণ বিশিষ্ট ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। (ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী)

আল্লামা হিফযুর রহমান, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, ডক্টর ইউসুফ উদ্দীন, ডক্টর আনোয়ার ইকবাল কোরেশী, শেখ মাহমুদ আহমদ, মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, ডক্টর নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকী, প্রফেসর খুরশীদ আহমদ, ডক্টর উমর চাপরা, বিচারপতি তাক্বী উসমানীসহ উপমহাদেশীয় মনীষীগণ ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং-এর দিগন্তকে আলোকিত করেছেন।

প্রিয় পাঠক, iBankHub এর এই ছিল ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী বিষয়ক আয়োজন। আশা করছি এই বিষয়ে আপনার কিছুটা ধারনা হয়েছে। আপনি চাইলে ইসলামি ব্যাংকিং সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পারেন। নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজটি লাইক ও ফলো করে রাখুন।

4 thoughts on “ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তার ক’জন দিশারী সম্পর্কে জানুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

rolex day date replica rolex daytona replica replica rolex sky dweller