ইসলামী অর্থনীতির প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে হয়, এটা কোনো নতুন অর্থনীতি নয়। এর মূল ভিত্তি রয়েছে কুরআনুল করীমে – যা চৌদ্দশত বছর আগে নাযিল হয়েছিল। এর অপর মূল ভিত্তি রয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষায়। আর এর প্রয়োগও শুরু হয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় গিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠন করেন। সেখানে বিভিন্ন জাতির লোকেরা ছিল। বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকেরা ছিল। রাসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবী ছিলেন – একই সাথে তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
সকল বিষয়ে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, মৌলিক সিদ্ধান্তগুলো। তাঁর আমলে তাঁরই নির্দেশনায় সে দেশের অর্থনীতিসহ সবকিছু পরিচালিত হচ্ছিল। তখন থেকেই স্বাভাবিকভাবে মদিনা রাষ্ট্রে ইসলামী অর্থনীতির প্রয়োগ শুরু হলো।
তিনি যে সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য পেয়েছিলেন তাতে দেখলেন তার মধ্যে কিছু ব্যবসা জুলুমমূলক । সেগুলো সুবিচারমূলক নয়। সেগুলোকে তিনি বাতিল করে দিলেন (যেমনঃ মুলামাসা এবং মুনাবাদা, দ্রষ্টব্য – বুখারী, কিতাবুল বাই)।
তেমনি কৃষির ক্ষেত্রেও কিছু ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ থাকায় তিনি তাও বাতিল করে দেন। তিনি অনেক উৎপাদনকে বাতিল করে দেন। যেমন সে দেশে মদ উৎপাদন করা সম্ভবপর ছিল না । তিনি কিছু পেশাকেও অবৈধ ঘোষণা করলেন।
জুয়া খেলা সেখানে যেমন সম্ভব ছিল না তেমনি অশ্লীল কোনো দ্রব্য উৎপাদনও সম্ভব ছিল না । সুতরাং ইসলামী অর্থনীতির প্রয়োগ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগেই শুর হলো।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের শেষ দিকে এসে সুদ সম্পূর্ণরূপে উৎখাত হয়ে যায়। তখন সুদমুক্ত একটি অর্থনীতি এসে যায় – যার মূল ভিত্তি ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য । তখন থেকেই ব্যক্তিমালিকানা কিংবা শরীকানায় ব্যবসা হতো। শরীক মালিকানায় লাভ-লোকসানকে ভাগ করে নেয়া হতো।
কিংবা একজনের মূলধন হলে অন্যজনের শ্রম হতো যাকে মুদারাবা (Mudaraba) বলা হয়। সেই ব্যবস্থাতেও লাভ বা লোকসান ভাগ করে নেয়া হতো। এই মূলনীতির ভিত্তিতেই উমাইয়া (এর সময় প্রায় একশ’ বছর) এবং আব্বাসীয় (প্রায় সাত-আটশ’ বছর)-এই সম্পূর্ণ যুগে ইসলামী অর্থনীতি চালু ছিল।
এখানে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না – উমাইয়াদের শাসন ব্যাপক এলাকায় ছিল। উত্তর আফ্রিকাসহ ভারতের একটা অংশ তাদের অধীনে ছিল। মধ্য এশিয়া ও গোটা মধ্যপ্রাচ্যও তাদের অধীনে ছিল।
পরবর্তীতে আব্বাসীয়দের আমলে এটা আরো বিস্তার লাভ করে। কাজেই সেটা ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে বড় শক্তি (Greatest super power)। তারা ছিল তখনকার সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রশক্তি, আন্তর্জাতিক শক্তি এবং সামরিক শক্তি।
আমরা জানি, সেই সময়ে অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছিল। শিল্পের, ব্যবসার, যোগাযোগের ক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়েছিল। শিক্ষা, সাহিত্যের উন্নয়ন হয়েছিল। স্থাপত্যের উন্নয়ন হয়েছিল।
সুতরাং বলা যায়, তারা একটি উন্নত সভ্যতার অধিকারী ছিল। তাদের সে রাষ্ট্রেরও আইনগত ভিত্তি ছিল ইসলামী শরীয়ত। সেই রাষ্ট্রের বৈধতার (Legitimacy) ভিত্তি ছিল ইসলাম বা আল কুরআনুল করীম। কাজেই সেই রাষ্ট্র ইসলামী অর্থনীতিকে ফলো করছিল।
এখন ইসলামী অর্থনীতি বলতে কি বোঝায়? সেই যুগে যে প্রযুক্তি (Technology) ছিল সেটাই কি ইসলামী অর্থনীতি? নাকি অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইসলামের যে শিক্ষা, ইসলামের যে লক্ষ্য এবং ইসলামের যে মূল্যবোধ সেগুলোকেই কার্যকর করা হচ্ছে ইসলামী অর্থনীতি? আবার ইসলামী অর্থনীতির প্রশ্নে বলা যায় – কি অর্থে সেখানে ইসলামী অর্থনীতির প্রয়োগ করা হয়েছিল।
এটা স্বীকার করতেই হবে যে, টেকনোলজিই ইসলামী অর্থনীতির মূল কথা নয় । কারণ টেকনোলজি যুগে যুগে পরিবর্তন হয়ে যায়। তেমনিভাবে যে ব্যবসায় সংগঠন (Business organization) – সেটাও মূল কথা নয়। আজকের দিনে আমরা করপোরেশন (Corporation) দেখছি, যেটা আগের দিনে ছিল না।
এই করপোরেশন সিস্টেম মাত্র একশ’-দুইশ’ বছর আগে এসেছে। অর্থাৎ বোঝা যায় যে, ব্যবসা সংগঠনের শেপ (Shape) কি বা কি পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যবসাকে বা প্রতিষ্ঠানটিকে সংগঠিত করা হয়েছে – সেটা মূল জিনিস নয়।
মূল জিনিস হলো কোন জিনিসে ব্যবসা করা বৈধ আর কোন জিনিসে ব্যবসা করা বৈধ নয় । কোন পদ্ধতিতে ব্যবসা করা বৈধ আর কোন পদ্ধতিতে ব্যবসা করা বৈধ নয়।
কাজেই আমরা যখন ইসলামী অর্থনীতির কথা বা এর প্রয়োগের কথা বলছি তখন আমরা বোঝাচ্ছি তার নীতিগুলোকে, তার মূল্যবোধ, তার লক্ষ্য কি। সে কি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন চাচ্ছে – এই ভিত্তিতে আমরা এই বিষয়টিকে দেখছি।
আজকের দিনে যে ইসলামী অর্থনীতি হবে, সেখানে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করা হবে। নতুন যে বিজনেস অর্গানাইজেশন, যেমন আগে উল্লেখিত করপোরেশন অথবা জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ (Joint stock companies ) – এগুলো সেখানে থাকবে।
এখানে শেয়ার (Share) ব্যবস্থা থাকবে। আগের দিনে শেয়ারের ধারণা ছিল না। বাস্তবে বিভিন্ন মালিকানা থাকলেও তখন শেয়ার সার্টিফিকেট ছিল না, শেয়ারের ভিত্তিতে মালিকানা ভাগ করা হতো না, এগুলো সবই গ্রহণ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে আমরা জানি ওআইসি’র (OIC) ফিকাহ একাডেমি এগুলোকে বৈধ ঘোষণা করেছে। শ্রেষ্ঠ আলিম দ্বারা সকল যুগেই এসব অর্গানাইজেশন, নতুন টেকনোলজি বা শেয়ার সার্টিফিকেট (যদি তা বৈধ ব্যবসার হয়) – তাকে তারা বৈধ ঘোষণা করেছেন।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে এখন যদি আমরা এর ঐতিহাসিকভাবে প্রয়োগের দিকে লক্ষ্য করি – যেমন এখানে এতক্ষণ যা আলোচনা করা হলো – তাহলে আমরা দেখতে পাব ইসলামী অর্থনীতির প্রয়োগের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর হয়েছিল।
আর এটা এই জন্যেই সম্ভব হয়েছিল যে, ইসলামের যে যাকাত ব্যবস্থা এবং ইসলামের ওয়াকফ’র যে ব্যবস্থা তার মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করা সহজ। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, প্রকৃতপক্ষে অর্থনীতি প্রধানত সরকারি ছিল না। এটা একদল ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দ্বারা সংগঠিত ছিল।
ইসলামী অর্থনীতি যেহেতু অর্থনীতির স্বাভাবিক বিকাশে বিশ্বাস করে, মানুষের যে উদ্ভাবনী শক্তি তার উপর বিশ্বাস করে, মানুষের যে যোগ্যতা (Capacity) তার উপর বিশ্বাস করে এবং যেহেতু ইসলাম মানুষকে প্রয়োজনীয় কিছু বিধি-নিষেধের আওতায় স্বাধীনতা দেয়, ফলে সে অর্থনীতি সাধারণত বিকাশমান হয়।
অগ্রগতিমুখী হয়। সে কারণেই অর্থনীতি তখন উন্নতি করেছিল। আর অর্থনীতি উন্নত করার কারণে দারিদ্র্য কম ছিল।
একইভাবে তখন ইসলামী অর্থনীতির জন্যে কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রসার ঘটে। ইন্ডাস্ট্রিজ ফ্লারিশ (Flourish) করেছিল। তখন দারিদ্র্য খুব কমই দেখা দেয় এবং যাও দেখা দিয়েছিল তা প্রাকৃতিক কারণে, দুর্ভিক্ষ (Famine) দেখা দেয়ায়।
দেখা গেলো কোনোখানে বৃষ্টিপাত হয়নি। আর এসব কারণে যেখানে সমস্যা দেখা দিয়েছে তা সাধারণত সরকার তার রাজস্ব ব্যবহার করে, তার বায়তুল মালের অর্থ দ্বারা সেটাকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে এবং তা করেছে।
আর এ ধরনের পরিস্থিতির কথা যদি আমরা বাদ দেই তাহলে সাধারণভাবে যে পরিস্থিতি ছিল তাতে যাকাতের মাধ্যমে দারিদ্র্যের সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। তখন খুব কম লোকই গরীব ছিল।
কিন্তু যারা ধনী তাদের (অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে) প্রচুর অর্থবিত্ত ছিল। তাদের যাকাত হতো। মুসলিম ইতিহাসে এমন অনেক সময় গেছে যখন যাকাত দেয়ার মতো তারা লোক পেতেন না।
এরপর ওয়াকফ’র কথা যদি বলি তাহলে বলব ইসলামে দানকে, ইনফাক ফি সাবীলিল্লাহ – আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। ফলে সকলেই চাইতেন কিছু সম্পদ দরিদ্রদের মধ্যে ওয়াকফ করে দিতে।
এই ওয়াকফ’র আয় থেকে শুধুমাত্র ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চলত বা আমরা যাকে সরাইখানা বলি (অর্থাৎ তখনকার পথিক বা আগন্তুকদের জন্য যে মেহমানখানা) তা চলত যা সরকার চালাতেন।
তখন প্রায় সবখানেই সরাইখানা করা হতো। এইসব ওয়াকফ’র আয় দ্বারা ছাত্রদের বেতন দেয়া হতো। দরিদ্রদের সাহায্য করা হতো। তাদের বৃত্তি দেয়া হতো। এমনিভাবে সার্বিক অভাব মুসলিম বিশ্ব থেকে দূর করা সম্ভব হয়েছিল।
তখন মুসলিম বিশ্বের কোনো ব্যক্তি অভাবী ছিলেন বা দরিদ্র ছিলেন বা না খেয়ে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে – এরকম ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। কিংবা বলা যায় ঘটেনি, বিশেষ করে উমাইয়াদের আমল থেকে শুরু করে কলোনিয়াল (Colonial) ব্যবস্থার উত্থানের আগ পর্যন্ত। ইসলামে যাকাত এমন একটি ব্যবস্থা যা কঠিন দারিদ্র্য (Hardcore pover- ty) দূর করতে সক্ষম।
এর মূল কারণ হলো বর্তমানে আমাদের কিংবা বিভিন্ন দেশে যে এনজিওগুলো (NGO) তারা যে স্বল্প ঋণ দেয় (যদি টাকার হিসেবে বলি, পাঁচ হাজার বা দশ হাজার এরকম) আর তা তাদেরকে এক বছর, ছয় মাস, তিন মাস, এমনি করে বিভিন্ন সময়ের মধ্যে ফেরত দিতে হয়।
এ সমস্ত স্বল্প আয় থেকে ঋণ ফেরত দেয়া এবং তার উপর আবার বাড়তি সুদ ফেরত দেয়া – যেটা এনজিওরা চায় তা প্রকৃতপক্ষে সম্ভব হয় না। এ জন্য এনজিওরা দারিদ্র্য বিমোচন করতে বিশেষ করে (Hardcore poverty) দূর করতে পারে না।
কিন্তু ইসলামে যে যাকাত ব্যবস্থা, সেটা হলো প্রকৃতপক্ষে ট্রান্সফার (Transfer), এটা একবারে দিয়ে দেয়া হয়; এটা আর ফেরৎ নিতে হয় না । এ প্রসঙ্গে আমাদের স্কলাররা বলেছেন, যাকাত এমন পরিমাণ দিতে হবে যাতে যাকাতগ্রহীতা স্বাবলম্বী হয়ে যায়।
ইসলামী অর্থনীতি : প্রয়োগ ও বাস্তবতা
অধিকাংশ ফিকাহবিদ এ কথাই বলেছেন যে, এমনভাবে দিতে হবে যাতে তাকে আর কারো কাছে যেতে না হয়। অর্থাৎ স্বাবলম্বী করে দাও, কিংবা অন্তত এই পরিমাণ দাও যাতে এক বছর আর তার কাছে ফিরে আসতে না হয়।
এই যে দৃষ্টিভঙ্গি তার বাস্তব প্রয়োগের কারণেই তখন কঠিন দারিদ্র্য (Hardcore poverty) দূর করা সম্ভব হয়েছিল। এখনও যদি মুসলিম বিশ্ব দারিদ্র্য দূর করতে চায় তাহলে যাকাতকে এবং যাকাতের সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের ট্রান্সফারের মাধ্যমেই এই কাজটি করতে হবে।
এক্ষেত্রে এনজিওদের প্রতি আমার পরামর্শ হবে এনজিওরা যেভাবে করছে তার মাধ্যমে হবে না। তাদের মধ্যে ট্রান্সফারের একটা উপাদান (Element) থাকতে হবে। ইসলামের দাবী এটা যে, তারা সুদভিত্তিক কোনোকিছু না করুক।
তারা সেটাকে মুসলিম দেশগুলোতে বিশেষ করে ইসলাম ভিত্তিতে করুক। এটা তারা সার্ভিস চার্জের ভিত্তিতে করতে পারে। তাতে তাদের লাভ হবে না কিন্তু তাদের খরচ উঠে আসবে।
এখানে সার্ভিস চার্জ হলো, যে পরিমাণ দিয়েছি তার উপর এত পরিমাণ নেয়া যাতে তার প্রশাসনিক খরচ (Administrative cost) আদায় হয়ে যায়। কিন্তু তার চেয়ে এক পয়সাও বেশি নিলে তা সুদ বলে গণ্য হবে। এটাই হলো ওআইসির ফিকাহ একাডেমির ফতোয়া বা ঘোষণা বা রুলিং।
এনজিওগুলোর উচিত হবে সার্ভিস চার্জের ভিত্তিতে করা – সঙ্গে সঙ্গে তাদের আর যেটা করতে হবে সেটা হলো এই ধরনের ঋণের সাথে ট্রান্সফারকে একত্র করা। কথা উঠতে পারে, যদি দান বা অনুদান দেই তাহলে সেটা তারা খেয়ে ফেলতে পারে।
তারা সেটা ফেরত দেবেও না বরং খেয়ে ফেলবে, তাতে কাজ হবে না। এই সমস্যাগুলো রয়েছে। আর এটা যে হতেও পারে তা অস্বীকার করা যায় না। আমাদের মধ্যে স্বভাব খারাপের জন্যে এরকম পরিস্থিতি হতে পারে। কিন্তু তথাপি আমাদের ভালো সুপারভিশনের মাধ্যমে এই পদ্ধতি সার্থক করার চেষ্টা করতে হবে, অন্য পদ্ধতিতে হবে না।
যাকাতের ব্যাপারে আইন কি হবে তার একটা স্ট্রাকচার আমরা ইতোমধ্যে পাকিস্তানে পেয়ে গেছি। সেদিক থেকে যাকাতের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। যদিও সরকারি পর্যায়ে আদায়ের ব্যাপারটি এখনো ভালো করে গড়ে ওঠেনি।
আদায় এবং বণ্টনের ক্ষেত্রে সেটাকেই এখন গড়ে তুলতে হবে। এটা সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমেও হতে পারে। রাষ্ট্র যদি বলে দেয় আমরা এই অংশটুকু পর্যন্ত আদায় করব, বাকীটা জনগণ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে আদায় করবে।
সেটাও সম্ভব, একেবারে অসম্ভব কিছু নয়। যদিও সেটার অনেক আইনগত বা শরীয়ত সংক্রান্ত দিক রয়েছে। সেগুলো পরীক্ষা করে আমাদেরকে দেখতে হবে। যদিও এটা বড় কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না (যাকাত সম্পর্কে দ্রষ্টব্য – ইসলামে যাকাতের বিধান, ড. ইউসুফ আল কারযাভী)।
আগে একসময় ছিল যাকাত মানুষ একদম দিত না। এখন যারা ব্যবসায়ী, যারা শিল্পপতি তারা যাকাতের জ্ঞান উপলব্ধি (Awareness) বা প্রকৃতি (Nature ) সম্পর্কে বুঝে গেছে। ফলে ভালো লক্ষণ হলো যারা এটা জানে তাদের অধিকাংশই এখন যাকাত দেন।
তারা যতটুকু বোঝেন ততটুকুই দেন। এ ক্ষেত্রে তাদের উপলব্ধি আরো ব্যাপক হওয়া প্রয়োজন। আলিমদের দায়িত্বও অনেক । এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, আলিমরা অনেক পুরোনো বই পড়েছেন কিন্তু তাঁদের আধুনিক বইও পড়া প্রয়োজন।
ইসলামে যাকাতের বিধান’ – আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভীর এই বইটি পড়লে দেখা যায় যে, যাকাত কত বড় মাধ্যম এবং এর মাধ্যমে বিশ্বের কত সমস্যার সমাধান করা যায়। অর্থনীতির কত সমস্যার সমাধান করা যায়।
এবং এর মাধ্যমে বিশ্বের কত সমস্যার সমাধান করা যায়। অর্থনীতির কত সমস্যার সমাধান করা যায়। হাজার বছর মুসলিম শাসনের পর মুসলিম শাসনের পতন হলো। জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে পড়লাম । তারই ফলে আমরা সর্বক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়লাম। ইসলামী অর্থনীতি
জ্ঞানের সাথে সাথে সামরিক ক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়লাম। কারণ মিলিটারী হার্ডওয়ার বা এর যে সুপিরিয়রিটি তার পেছনে রয়েছে নলেজ। আবার টেকনোলজী তারও পেছনে রয়েছে নলেজ । এই জ্ঞানের দিক থেকে পিছিয়ে পড়ার কারণে আমরা সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়লাম।
ফলে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো ( Colonial power) জোর করে আমাদের দেশ দখল করার সুযোগ পেয়ে গেল । আর তারা আমাদের দেশে এসে দুনিয়ার যত অবৈধ ব্যবসা সম্ভব তা শুরু করল। মদের ব্যবসা শুরু করল। আবার অন্যান্য সুদভিত্তিক কাজ কারবার চালু করল।
পরবর্তীকালে সুদভিত্তিক ব্যাংক চালু করল। ফলে এই কলোনিয়াল প্রভাবের কারণে মুসলিম বিশ্ব ইসলামী অর্থনীতি থেকে অনেকটা দূরে সরে গেল । ব্যক্তিগত জীবনে তারা মুসলিম থাকল। যতটা সম্ভব ইসলামী কালচার থাকল। কিন্তু তা সত্ত্বেও অর্থনীতিতে অনৈসলামিক উপাদান বাড়তে লাগল।
এরপর আবার ইসলামের নব উত্থান ঘটে। The new rise of Islam – ইসলামের নতুন করে জাগরণ শুরু হলো। সেটা ঘটে গত একশ’ বছর আগে। এরপর পঞ্চাশ ষাট বছর আগে বিভিন্ন দেশ স্বাধীন হতে থাকে। পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া স্বাধীন হলো।
আস্তে আস্তে মুসলিম দেশগুলো স্বাধীন হলো। সবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীন যে সব মুসলিম দেশ ছিল তা স্বাধীন হয়ে গেল। এসব রাষ্ট্রের মধ্যে বহু লোকই ইসলামের জন্য কাজ করতে লাগলেন। ইসলামী আন্দোলনের উত্থান হলো।
তারা ইসলামকে ব্যাখ্যা করতে লাগলেন এবং নতুন করে ইসলামী আইন (Legislation) লেখা শুরু হলো। পাকিস্তানে অনেক ধরনের আইন হলো – যাকাতের উপর, উশরের উপর। এমনকি তারা নতুন প্যানাল কোড করলেন । সাক্ষ্য আইন (Evidence Act) করলেন।
অন্যান্য আইনে ইসলামী ধারা সংযোজন করলেন। ইসলামী কন্সটিটিউশন করলেন। এভাবে ইরান, সুদানে একই ব্যাপার হলো । আবার মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াতে কিছু হলো। এভাবে সকল মুসলিম দেশে কিছু না কিছু ইসলামী আইন হতে লাগল।
বাংলাদেশেও কিছু হলো । শাসনতন্ত্রে কিছু ইসলামী ধারা যোগ হলো। যাকাত অর্ডিন্যান্স হলো। এর ফলাফল স্বরূপ ইসলামী ব্যাংকিং শুরু হলো। অর্থনীতির সবচেয়ে বড় একটা উপাদান বা টুল হচ্ছে ব্যাংকিং। এই ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেই অর্থের (Money) আদান-প্রদান হয় এবং এরই মাধ্যমে অর্থনীতি গড়ে ওঠে।
আমরা যদি ইসলামী ব্যাংকিংকে এগিয়ে নিতে পারি, ইসলামী ব্যাংকিং যদি জাতীয় ব্যাংকিং সিস্টেম হয়ে যায় তাহলে সুদ অটোমেটিক উঠে যাবে। আবার সুদের উপর মানুষের এমনিতেই আস্থা নেই । আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, মুসলিমরা সুদ চায় না, বাধ্য হয়েই সুদে জড়ায় ৷
ইসলামী ব্যাংকিং যদি সাকসেসফুল হয়, অনেক দেশে ইসলামী ব্যাংকিং মেজর ফ্যাক্টর হয় অথবা অধিকাংশ ব্যাংক ইসলামিক হয়ে যায় তাহলে সুদ ক্রমে দূর হয়ে যাবে বলে আমরা ধরে নিতে পারি। ইসলামী অর্থনীতি
নতুন যুগে এই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের যে প্রয়োগ শুরু হলো তা ইসলামী অর্থনীতিতে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে। প্রায় সকল মুসলিম দেশেই এখন ইসলামী ব্যাংক হয়ে গেছে। প্রায় তিনশ’র বেশি ইসলামী ব্যাংক তাদের অনেক শাখা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছে।
এই ব্যাংকগুলো আরো ব্যাপক হচ্ছে । এতে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, ইসলামী ব্যাংকিং সফল হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করছে। এছাড়াও তারা ইসলামের যে সামাজিক অর্থনৈতিক লক্ষ্যাবলী (Socio-economic objectives) তা কার্যকর করার জন্য চেষ্টা শুরু করেছে।
এসব লক্ষ্যের মধ্যে আছে মানুষের প্রয়োজনকে পূর্ণ করতে হবে, সুবিচার করতে হবে এবং তা যদি করতে হয়, মানুষের চাহিদা পূর্ণ করতে হয় তাহলে অনেক কিছুই আমাদের করতে হবে। এরমধ্যে অন্যতম একটা হলো পূর্ণ কর্মসংস্থান (Full employment)।
অর্থনীতিকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে মানুষের পূর্ণ কর্মসংস্থান হয়। কর্মসংস্থান হলে আয় হবে আর আয় হলে তাদের চাহিদা পূর্ণ হবে। আমরা যদি তাই কাজের বা নিয়োগের ব্যবস্থা না করতে পারি তাহলে আয় হবে না -আর আয় না হলে চাহিদাও অপূর্ণ থেকে যাবে, প্রয়োজনও পূর্ণ হবে না।
মানুষ সমাজের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে আর সেটা ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য নয় । ইসলামী অর্থনীতি চায়, যেসব লোক কোনোভাবেই কাজ জোগাড় করতে পারছে না (যেমন সে অসুস্থ বা অতি বৃদ্ধ বা বিধবা এরকম অন্যান্য অসুবিধা যাদের আছে) সেসব ব্যক্তিকে তার পরিবার প্রথমত চালাবে।
আর যদি তা সম্ভব না হয় আত্মীয়-স্বজন তারাও করবে। আর যদি তা না করতে পারে, তাহলে তা রাষ্ট্র করবে। এছাড়া ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য হচ্ছে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজে রোজগার করবে, ভালো রোজগার করবে। অর্থনীতিতে সফল হতে হবে। সে রোজগার করতে পারবে এবং সেই রোজগারের ভিতর তাকে চলতে হবে।
এসব করতে গেলে আজকের যুগে সমস্ত মুসলিম বিশ্বে রুরাল ইকোনমি (Rural economy) গড়ে তুলতে হবে। কারণ জনগণের একটা বিরাট অংশ, কোনো কোনো মুসলিম রাষ্ট্রে আশিভাগ – গ্রামে বাস করে। কোথাও ষাট ভাগ আবার কোথাও ত্রিশ বা চল্লিশ ভাগ গ্রামে বাস করে।
আরব দেশের কোথাও দশ বা বিশ ভাগ গ্রামে বাস করে। পাকিস্তানে ষাট বা পঁয়ষট্টি ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রে সত্তর ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। এসব কারণে আমাদের রুরাল অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে হবে।
আমাদেরকে গ্রামীণ অর্থনীতি; এগ্রিকালচারকে গড়ে তুলতে হবে। শুধু ইন্ডাস্ট্রি করলে চলবে না। ইন্ডাস্ট্রি করতে হবে কিন্তু কৃষিকে আমাদের গড়ে তুলতে হবে, যাতে গ্রামীণ জনগণের আয়-রোজগারের ব্যবস্থা উন্নত হতে পারে।
তেমনিভাবে শহরাঞ্চলকে যদি সামনে রাখি তাহলে বড় ইন্ডাস্ট্রি তো করতেই হবে। সাথে ছোট ইন্ডাস্ট্রিও করতে হবে। কারণ ছোট ইন্ডাস্ট্রি করতে পারলেই বেশি কর্মসংস্থানকে নিশ্চিত করা যায়। সেই সাথে আত্মকর্মসংস্থানের (Self employment) সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
এগুলো ব্যাপকভাবে করতে হবে। এসব কাজ বিভিন্ন এনজিও করতে পারে। সমাজ সাহায্য করতে পারে । আমরা একে অপরকে সাহায্য করতে পারি। ব্যাংকিং সিস্টেমের একটি অংশ এ কাজে ব্যয় হতে পারে। সরকারও এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
এভাবে আমরা ইসলামের সামাজিক লক্ষ্যগুলো – নীড ফুলফিলমেন্ট (Need fullfilment), জাস্টিস (Justice) যদি করতে পারি তাহলেই একটা সংঘাতমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করা সম্ভব হবে।
ইসলামী অর্থনীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। আমাদের দেশেই শুধু প্রত্যেক মুসলিম দেশেই যারা সমাজ চালাচ্ছেন – তাদের মধ্যে ইসলামের জ্ঞানের অভাব রয়েছে। এগুলোকে দূর করতে হবে।
মানুষের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে নানা কারণে, নানা ভীতি রয়েছে – যেহেতু ইসলাম খুব কঠিনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সে ভীতিগুলো দূর করতে হবে । তাহলেই আমাদের যে এলিট শ্রেণি, উচ্চ শ্রেণি বা সবচেয়ে শিক্ষিত শ্রেণি, তারা ভয়মুক্ত হবে। তারা তখন ইসলামের প্রয়োগের ব্যাপারে আগ্রহী হবে।
তেমনিভাবে পাশ্চাত্য এ ব্যবস্থা চায় না – সে সমস্যাও রয়েছে। আবার তারা তাদেরটা বাদ দিয়ে আমাদেরটাই বা চাইবে কেন? সে ক্ষেত্রেও সমাধান কঠিন। ইসলামী অর্থনীতি
কিন্তু আমরা যদি যোগ্য হয়ে উঠি – আমরা যদি আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি, আমরা যদি সবাই শিক্ষিত হয়ে যাই, আমরা যদি আমাদের অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে পারি; আমরা যদি আমাদের সম্পদকে (Resource ) ব্যবহার করতে পারি তাহলে পাশ্চাত্যের কাছে আমরা তত দায়বদ্ধ থাকব না।
আর আমরা যদি তাদের কাছে দায়বদ্ধ না থাকি তাহলে পাশ্চাত্যের সাথে সংঘাত না করেও আমরা আমাদের পদ্ধতি ফলো করতে পারবো। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এটা স্বীকার করতেই হবে, মুসলিম দেশগুলোতে নানা রকম ডিক্টেটরশিপ (Dictatorship) রয়েছে, রাজতন্ত্র রয়েছে।
এগুলো সহায়ক নয়। এগুলো ইসলামিকও নয়। আমাদেরকে আল্লাহর আইনের অধীনে জনগণের সরকার, যেটাকে আমরা শূরাভিত্তিক শাসন বলি বা যেটাকে আমরা গণতন্ত্র বলি সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
হিউম্যান রাইটস (Human rights) প্রতিষ্টিত করতে হবে। সকল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জবাবদিহিতামূলক (Accountable) সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এসব কথাই ইসলামী চিন্তাবিদগণ বলেছেন।
এগুলো যদি আমরা করতে পারি তাহলে আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে । ডিক্টেটরের অধীনে কোনো কোনো সময় সাময়িকভাবে উন্নতি হয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী (Long-term) ডিক্টেটরের অধীনে কল্যাণমুখী অর্থনীতি গড়ে ওঠে না।
আমরা সামনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখি, যদি ইসলামের সংকটগুলো, দারিদ্র্যের সংকট, শিক্ষার সংকট, পাশ্চাত্য শক্তির সঙ্গে আমাদের যে সংঘাত- এই সংঘাতগুলোকে আমরা যদি কাটিয়ে উঠতে পারি, আমরা যদি আমাদের নিজেদের যে দুর্বলতাগুলো রয়েছে, আমাদের মধ্যে যে অতি গোঁড়ামী রয়েছে, কোথাও কোথাও যার কোনো ইসলামী ভিত্তি নেই – সেগুলো যদি আমরা দূর করতে পারি; আমরা যদি একটা Balanced understanding of Islam অর্জন করতে পারি, আমরা যদি সামঞ্জস্যপূর্ণ উপলব্ধি (ফিকাহ) অর্জন করতে পারি – তাহলে আমি মনে করি, ইসলামী অর্থনীতি ক্রমাগতভাবে শক্তিশালী হতে থাকবে।
এর জন্য ইসলামী জ্ঞানের ব্যাপক বিস্তার করা দরকার । ইসলামী সাহিত্যের ব্যাপক বিস্তার করা দরকার। ইসলামের যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে ওঠা দরকার । ইসলামী আন্দোলনগুলোকে আরো যোগ্য হওয়া দরকার। এসব যদি করা সম্ভব হয় তাহলে মুসলিম বিশ্ব ক্রমাগতভাবে ইসলামী অর্থনীতির নিকটে চলে আসবে।
তাহলে মুসলিম বিশ্ব থেকে সুদ উঠে যাবে। অবৈধ ব্যবসা উঠে যাবে, জালিয়াতি কমে যাবে। ভেজাল, মিথ্যা, ধোঁকাবাজি কমে যাবে – যদিও রাস্তা যে দুর্গম তা অস্বীকার করা যায় না। এর জন্য অনেক পরিশ্রম দরকার, অনেক প্রচেষ্টা দরকার – সেগুলোকেও অস্বীকার করা যায় না। ইসলামী অর্থনীতি
আরো পড়ুন: ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল