ইসলামী অর্থনীতি ও তার বাস্তবায়ন

বিশেষজ্ঞদের ব্যাপক গবেষণার ফলে ‘ইসলামী অর্থনীতি’ বিষয়টি একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়েছে। অবশ্য প্রত্যেক বিষয়েরই বিকাশ হতে থাকে এবং ইসলামী অর্থনীতিও ভবিষ্যতে বিষয় হিসেবে ব্যাপক বিকাশ হবে বলে আশা করা যায়।

সলামী অর্থনীতির বিষয়বস্তু (Scope) নিয়ে কিছু অস্পষ্টতা আছে। সাধারণভাবে ইসলামী অর্থনীতি বলতেই ‘যাকাত’ ও ‘সুদ’ সংক্রান্ত আলোচনা, খুব বেশি হলে ইসলামী ব্যাংক সংক্রান্ত আলোচনাকে বোঝা হয়। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়।

অর্থনীতির তত্ত্বগত ও প্রয়োগ সংক্রান্ত সকল বিষয়ই ইসলামী অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়। ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য হচ্ছে জনকল্যাণ, সুবিচার প্রতিষ্ঠা, দারিদ্র্য নিরসন, নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার ও যথাযথ বণ্টন।

ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলাম একটি ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক স্বাধীন অর্থনীতি কায়েম করতে চায় যাতে উৎপাদনের, ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাধীনতা থাকবে, যেখানে শ্রমিকের অধিকারের দিকে বিশেষ নজর দেয়া হবে, যেখানে বিনিয়োগ হবে প্রধানত অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে (মুদারাবা ও মুশারাকা), যেখানে অভাবগ্রস্তদের সমস্যা দূর করার জন্য যাকাত ও অন্যান্য সম্পদ ব্যবহার করা হবে।

অর্থাৎ ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধি, যথাযোগ্য বণ্টন ও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমেই ইসলাম তার অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করবে। এ প্রেক্ষিতে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, “ইসলামী অর্থনীতি’ বিষয়ে (Subject) উৎপাদন, বণ্টন, ব্যবসা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ এসব এবং এগুলোর থিওরী অন্তর্ভুক্ত হবে ।

এসব থিওরী না বুঝে কেউ উৎপাদন, বণ্টন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রক্রিয়া ভালো করে সম্পন্ন করতে পারবে না। সুতরাং Micro ও Macro economics-এর সকল বিষয়ই ইসলামী অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত থাকবে এবং তা পড়তে হবে।

অবশ্য থিওরীর সকল ক্ষেত্রে না হলেও অনেক ক্ষেত্রে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হতে হবে এবং তা ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ তাদের বইয়ে আলোচনাও করেছেন। অর্থনীতির অধিকাংশ থিওরীকে পুঁজিবাদের অংশ মনে করা একেবারে অসঙ্গত।

এগুলো হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ধরনের তত্ত্ব, যেমন Theories of price, firm, trade – যা সকল চিন্তাধারাতেই ব্যবহার করা যায়।

উপরের আলোচনায় পরিষ্কার হলো যে, ইসলামী অর্থনীতির Scope বিশাল। ইসলামী বাজার ব্যবস্থার স্বরূপ সম্পর্কেও কিছু বিভ্রান্তি আছে। ইসলাম বাজার ব্যবস্থাকে স্বীকার করে এবং গুরুত্ব দেয়।

বাজার (Market)-এর মাধ্যমে চাহিদা (Demand), ভোক্তার পছন্দ ( Preference) বোঝা যায়। সে মোতাবেক উৎপাদনও যোগান দেয়া যায়। চাহিদা ও যোগান দ্বারা মূল্য বা Price নির্ধারিত হয়ে থাকে।

ইসলামের শুরুতে যে অর্থনীতি বিরাজ করছিল তাতে দেখা যায় যে উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয়, বিনিয়োগ ও মূল্য নির্ধারণ স্বাধীনভাবে হতো, যদিও তা ইসলামের হালাল ও হারামের নীতির অধীন ছিল। এটাকে স্বাধীন বাজার ব্যবস্থা বলতে হয়।

কিন্তু ইসলাম আমাদেরকে বাজারের দাস ( Servant) হতে বলেনি। বাস্তবক্ষেত্রে আমাদেরকে ইসলামের অন্যান্য নীতিমালাও অনুসরণ করতে হবে। যেমন বাজারের নামে শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি না দেয়া চলবে না। শ্রমিককে বাঁচার মতো মজুরি দিতে হবে।

পুরাতন পুঁজিবাদের সময়ে বাজারের নামে শ্রমিককে বঞ্চিত করা হতো, তাদের উপযুক্ত মজুরি দেয়া হতো না। যার ফলে সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব উদ্ভাবিত হয় আর নানা দেশে রক্তাক্ত বিপ্লব সংগঠিত হয় এবং বিশ্বের অনেক দেশ প্রায় ৮০ বছর একধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাসত্বে বাস করে।

ইসলামী অর্থনীতি ও তার বাস্তবায়ন

ইসলামী অর্থনীতি ও তার বাস্তবায়ন

ইসলাম এ ধরনের নীতি সমর্থন করে না । ইসলাম আমাদেরকে আবদুল্লাহ (আল্লাহর দাস) হতে বলে, বাজারের দাস (আবদুল মার্কেট) হতে বলে না । বাজার অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু শ্রমিক ও বঞ্চিতদের অধিকার সমানভাবে বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

শ্রমিক ও কর্মচারীকে ন্যায্য মজুরি দিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারে, কেবল সেগুলো Long-term টিকে থাকবে। যারা তা পারে না, তাদেরকে তাদের বিনিয়োগকে নতুন ক্ষেত্রে সরিয়ে নিতে হবে, যাতে তারা ন্যায্য মজুরি দিয়েও টিকে থাকতে পারে। ইসলামের সঠিক নীতিমালা এটাই।

কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশে ইসলামী প্রশাসন হলে কি দ্রুত অবস্থার উন্নতি হবে? এ প্রশ্নের উত্তর কঠিন; এটা নির্ভর করবে ইসলামী প্রশাসনের যোগ্যতার উপর। যদি তারা যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেন তবে কর না বাড়িয়েও একই টাকা সদ্ব্যবহার করে অধিকতর কাজ করতে পারবেন।

ইসলামী প্রশাসন হলে উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতি দূর হবে যার ফল নিচের দিকেও যাবে। তারা যাকাত বাধ্যতামূলকভাবে আদায় করে কয়েক বছরের মধ্যে acute poverty দূর করতে পারবেন বলে মনে করি।

তবে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সময় লাগবেই । রাজস্ব বাজেট বা উন্নয়ন বাজেটে বিভিন্ন খাতে যে ধরনের বরাদ্দ আছে তাতে তেমন পরিবর্তনের অবকাশ নেই। আসলে প্রায় সব খাতেই আরো বরাদ্দ প্রয়োজন অথচ সে পরিমাণ অর্থ আমাদের হাতে নেই।

কর ফাঁকি রোধ, প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এসব ক্ষেত্রে উন্নতি করা সম্ভব হলে কর রাজস্ব বৃদ্ধি, বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করে উন্নয়ন দ্রুততর করা সম্ভব হবে।ৎ

One thought on “ইসলামী অর্থনীতি ও তার বাস্তবায়ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.