বর্তমান যুগে ইসলামী অর্থনীতি কি রূপ নেবে তা নির্ধারণ করার জন্য আমাদের রাসূলুল্লাহ (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদার আমলে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল, তাকে ভালো করে বুঝে নিতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর মদিনার জীবনের শেষ দিকে এমন একটি অর্থনীতি কায়েম করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা কুরআনের শিক্ষার আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল।
সে অর্থনীতি জাহেলিয়াতের যুগের সব অন্যায়, অত্যাচার ও বেইনসাফী হতে মুক্ত ছিল এবং সে কাজটি রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে করেছিলেন— যিনি আল্লাহপাকের দ্বারা তখন সতত পরিচালিত হতেন। সে অর্থনীতির ভিত্তি ছিল ইসলামী সুবিচার।
মক্কার জীবনে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইসলামী শিক্ষার মূলনীতি প্রচার করেছিলেন। একটি সমাজ ও অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ তখন তিনি পাননি।
মদিনার জীবনের প্রথমদিক অতিবাহিত হয়েছিল আত্মরক্ষা ও সমাজকে ধীরে ধীরে অনৈসলামী জাহেলী রীতি-রেওয়াজ হতে পবিত্র করার কাজে। সুতরাং মদিনার জীবনের শেষদিকে যে অর্থনীতি ও বণ্টনব্যবস্থা চালু ছিল, তাকেই আমরা ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল বলে ধরে নিতে পারি।
এ মডেলটিই খোলাফায়ে রাশেদার আমলে সুসামঞ্জস্য ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। এ যুগে ইসলামী অর্থনীতির একটি সঠিক মডেল তৈরি করার জন্য যেসব মূলনীতি ও নজীর দরকার তা আমাদেরকে কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রাথমিক যুগের ইসলামী অর্থনৈতিক মডেল হতে গ্রহণ করতে হবে।
কেননা, আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ইসলামের আদর্শ ও শিক্ষার আলোকে আজকের যুগের উপযোগী অর্থনৈতিক একটি মডেল তৈরি করা – নিজেদের মনগড়া মতবাদকে ইসলামের উপর চাপিয়ে দেয়া নয়। ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল
মদিনায় যে নতুন অর্থনীতি কায়েম করা হয়েছিল তাতে প্রত্যেকের স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করার অধিকার ছিল। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই স্বাধীনভাবে ব্যবসা, কৃষি, পশুপালন ও অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত ছিল । উৎপাদন কার্য স্বাধীনভাবে চলত। ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল
কৃষকরা ক্ষেতে ফসল উৎপন্ন করতে পারতো। তারা নিজেরাও পরিশ্রম করতো এবং প্রয়োজনবোধে মজুরও নিয়োগ করতো । ইতিহাসে অনেক সাহাবির মজুরির বিনিময়ে কাজ করার উদাহরণ রয়েছে। পেশার স্বাধীনতার কথা অবশ্য কুরআন মজীদেও স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে।
সূরা বাকারায় বলা হয়েছে, “তোমাদের জন্য ব্যবসাকে হালাল করা হয়েছে”
(আয়াত ২৭৫)
এবং সূরা জুমআতে রয়েছে, “তোমরা নামাজ শেষে দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর দেয়া জীবিকা অনুসন্ধান করো। “
(আয়াত ১০)।
বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত লোকেরা তাদের উৎপাদিত খাদ্য ও অন্যান্য ব্যবহার্য দ্রব্য বাজারে নিয়ে আসতেন । যাদের এসব দ্রব্যের প্রয়োজন হতো তারা বাজার থেকে এসব দ্রব্য খরিদ করে নিতেন। ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল
সাধারণত যোগানের উপর কোনো হস্তক্ষেপ করা হতো না । তেমনিভাবে চাহিদার উপরও হস্তক্ষেপ করা হতো না। কোনো মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হতো না। যোগান ও চাহিদার পরিস্থিতির উপর মূল্য নির্ভর করতো।
অবশ্য যোগান ও চাহিদাকে অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করাও নিষিদ্ধ ছিল । যেমন মজুতদারী নিষিদ্ধ ছিল, যাতে যোগানের উপর খারাপ প্রভাব না পড়ে। একবার হযরত ওমর (রা.) এর সময় এক ব্যবসায়ী বাইরে থেকে অনেক ঘোড়া এনে মদিনায় রাখতে শুরু করেন। ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল
হযরত ওমর (রা.) তাকে ঘোড়ার খাবার মদিনার বাইরে থেকে না আনা পর্যন্ত এসব ঘোড়াকে মদিনার অভ্যন্তরে রাখতে নিষেধ করে দেন। ফলে সে ব্যবসায়ী ঘোড়ার খাবার মদিনার বাইরে থেকে আনার ব্যবস্থা করেন। এ থেকেও স্পষ্ট হয় যে, মদিনায় ঘোড়ার খাবারের চাহিদার উপর যেন হঠাৎ প্রভাব না পড়ে সে জন্যই তিনি এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
এখানে এ কথাও উল্লেখ করা জরুরি যে, যদিও স্বাভাবিক অবস্থায় মূল্য নির্ধারণ না করাই ইসলামের নীতি, তথাপি যদি দ্রব্যমূল্য ইনসাফের সীমা অতিক্রম করে যায় এবং জুলুমের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তেমন অবস্থায় সরকার মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারে।
কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে যে অর্থনীতি গড়ে ওঠে তা ছিল ইসলামী শিক্ষার আওতাধীন এক স্বাধীন অর্থনীতি। উৎপাদন কার্যক্রম ও জীবিকা অর্জন সে অর্থনীতিতে স্বাধীনভাবে হতো। ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল
বাজারও ছিল সেখানে স্বাধীন এবং চাহিদা ও যোগানের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক প্রভাবে সেখানে শ্রম, দ্রব্য ও অন্যান্য সরবরাহের মজুরি ও মূল্য নির্ধারিত হতো। অর্থ বা বিনিময়ের মাধ্যমে এসবের লেনদেন চলতো। কিন্তু এ অর্থনীতি স্বাধীন অর্থনীতি হলেও তা অবাধ ছিল না।
এ অর্থনীতিকে তাই আধুনিক বা পুরোনো পুঁজিবাদের সঙ্গে সাদৃশ্যের জন্য কিছুতেই এক করে দেখা যেতে পারে না। কেননা যদিও বর্তমান পুঁজিবাদে কারো ঠিক নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা নেই, কিন্তু তাতে ব্যক্তির উপর আইনেরই নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত অপর্যাপ্ত; কাজেই সুবিচার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা তাতে নেই।এ
খানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ইসলামী অর্থনীতিতে উৎপাদন, উপার্জন, ব্যয়, ভোগ, সঞ্চয়, বিনিয়োগ ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই ব্যক্তির উপর অনেক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। আধুনিক পুঁজিবাদে এক ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে উইল করে তার সম্পত্তি যেভাবে ইচ্ছা দিয়ে যেতে পারে।
সে ইচ্ছা করলে সম্পত্তি যে কোনো একটি মাত্র সন্তানকে দিয়ে যেতে পারে, এমনকি অন্যান্য সন্তানদের বঞ্চিত করে প্রিয় কুকুরের ভরণপোষণের জন্যও দিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ইসলামে এ ধরনের স্বাধীনতার কোনো স্বীকৃতি নেই। এ ব্যাপারে প্রত্যেক ব্যক্তি ইসলামী মিরাসী আইনের অধীন।
ব্যক্তিগত মালিকানা
এখন আমরা ইসলামের প্রাথমিক অর্থনীতিতে মালিকানা কি অবস্থায় ছিল তা বিচার করবো । এই অর্থনীতিতে প্রত্যেক ব্যক্তি বাড়ি, সাওয়ারী, অস্ত্র ও জমির মালিক হতে পারতো । সে জমিতে স্বাধীনভাবে কৃষিকাজ করতে পারতো। ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল
ব্যক্তি জমি কিনতে ও বিক্রি করে দিতে পারতো। শিল্প সে সময় উন্নত পর্যায়ের ছিল না। কিন্তু কাপড় বোনা, অস্ত্র নির্মাণ, সাধারণ কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুত ও অন্যান্য আসবাবপত্র শিল্প ব্যক্তিমালিকানার অধীনেই ছিল।
এসব ব্যক্তিমালিকানার সুযোগে অনেকেই প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হয়েছিলেন। এদের মধ্যে হযরত ওসমান (রা.) ও আবদুর রহমান ইবনে আওফের (রা.) নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। কাজেই ব্যক্তি মালিকানা সে সমাজে স্বীকৃত ছিল।
অবশ্য ব্যক্তি তার মালিকানাধীন চাষোপযোগী জমিকে পতিত রাখতে পারতো না। তাকে জমি চাষ করতে হতো। তিন বৎসরের বেশি কেউ কোনো জমি ফেলে রাখলে সরকার তা নিয়ে নিতো।
এ সম্পর্কে হযরত ওমরের (রা.) বিশেষ আদেশ ছিল। কিন্তু কোনো ব্যক্তি সমাজের জন্য জরুরি কতকগুলো জিনিসের একক মালিক হতে পারতো না। যেমন খনি, পশুপালন-ভূমি, জঙ্গল, নদী-নালা, কূপ ও পানির উৎস ইত্যাদি। ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল
এখানে এ কথা পরিষ্কার করে দেয়া দরকার যে, ইসলামে কারো কোনো নিরঙ্কুশ মালিকানা নেই। মালিকানা এখানে আমানত মাত্র। কেননা কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা হচ্ছে:
পৃথিবী ও আকাশ মণ্ডলের সব কিছুর মালিক হচ্ছেন আল্লাহ।
(সূরা বাকারা: আয়াত ২৫৫)
পৃথিবীর মালিক হচ্ছেন আল্লাহ।
(সূরা আল-আরাফ: আয়াত ১২৮ )
ফকিহদেরও সম্মিলিত মত হচ্ছে যে, সেই মালিকানাই ন্যায়সংগত ও বৈধ যা শরিয়ত প্রণেতা দান করেছেন বা স্বীকার করে নিয়েছেন। মালিকানা স্বতঃসিদ্ধ নয় বরং শরিয়ত দাতার অনুমতিতে তা অস্তিত্বে আসে।
বৈধ উপায়ে অর্জিত সব সম্পদের মালিকানা মদিনার অর্থনীতিতে স্বীকৃত ছিল । হারাম উপায়ে সম্পদ অর্জন করা ও তার মালিক হওয়া অবৈধ ছিল। অর্জন করা ছাড়াও দান ও মিরাসী পদ্ধতিতে ব্যক্তি সম্পত্তির মালিক হতে পারতো। ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল
সুদহীন অর্থনীতি
মদিনায় সুদহীন অর্থনীতি চালু ছিল। কুরআন মজীদে দ্ব্যর্থহীনভাবে সুদকে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে (সূরায়ে বাকারা)। মদিনার ব্যবসায়ীরা নিজের অর্থে ব্যবসা করতেন অথবা অন্যের নিকট থেকে লাভ-লোকসানে অংশীদার হওয়ার ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করে ব্যবসার জন্য প্রয়োজনাতিরিক্ত মূলধনের ব্যবস্থা করতেন।
লাভের অংশ ঋণদাতাকে দিয়ে দিতেন। শরীকানা ভিত্তিতেও ব্যবসা করা হতো। শরীকানা ব্যবসায়ে হয় দু’জনের পুঁজিই খাটানো হতো অথবা একজনের পুঁজি ও অন্যজনের শ্রম সংযুক্ত হতো এবং নির্দিষ্ট হারে লাভ- লোকসানের ভাগ করা হতো। ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল
ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বিনা সুদে একজন অন্যজনের নিকট হতে ঋণ গ্রহণ করতেন। সমাজের প্রয়োজন এ পদ্ধতিতে মোটামুটি মিটেও যেত, কেননা কুরআন মজীদে ‘করজে হাসানা’কে উৎসাহিত করা হয়েছে।
মদিনার অর্থনীতিতে কোনো আধুনিক ধরনের ব্যাংক কায়েম ছিল না। এ কারণে আধুনিক অর্থনীতিতে সুদের যেসব খারাপ প্রভাব রয়েছে অথবা ব্যাংক মুদ্রা সৃষ্টির মাধ্যমে যে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় তা মদিনার ইসলামী অর্থনীতিতে দেখা দেয়নি। ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল
অর্থনীতি ও ব্যাংককে কি করে সুদমুক্ত করা যেতে পারে তা অবশ্য আলাদা করে আলোচনা করার বিষয়। এখানে শুধু একটি কথা উল্লেখ করা যায় যে, আধুনিক অর্থনীতিকে একবারে সুদমুক্ত করা হয়ত যাবে না, তবে অর্থনীতির এক-একটি অংশকে পর্যায়ক্রমে সুদমুক্ত করতে হবে।
ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল

মজুরের অধিকার
মদিনার অর্থনীতিতে মজুররা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতো। তারা কোনো বিশেষ ব্যক্তির অধীনে কাজ করতে বাধ্য ছিল না। যে কোনো ব্যক্তির অধীনে কাজ করা বা মালিক বদল করার ব্যাপারে তারা নিজেরাই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতো। ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল
মদিনার সমাজে শ্রমিকদের মর্যাদাশীল নাগরিক মনে করা হতো। শ্রমিকদের মর্যাদা মালিকদের থেকে কম মনে করা হতো না। মদিনায় বসবাসকারী মুহাজিররা আনসারদের বাগানে কাজ করতেন কিন্তু মুহাজিরদের মর্যাদা এতে কোনো অংশে কমে যায়নি।
বড় বড় সাহাবিরা, যারা পরবর্তীকালে ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা হয়েছিলেন, অন্য মুসলমানের এমনকি মদিনার অমুসলিম ইহুদিদের নিকটও মজুরির বিনিময়ে কাজ করেছেন। মজুরদের সামাজিক মর্যাদা ইসলামের শিক্ষা হতেই মদিনার ইসলামী সমাজে সৃষ্টি হয়েছিল। ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল
তাকওয়ার কারণে যে মর্যাদার পার্থক্য সৃষ্টি হয় তা ছাড়া অন্য কোনো কারণে ইসলাম মর্যাদার পার্থক্য স্বীকার করে না। কুরআন মজীদে ইরশাদ করা হয়েছে:
তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট তারাই অধিক সম্মানিত যারা অধিক তাকওয়াশীল।
(সূরা হুজরাত: আয়াত ১৩)
নবী করিম (সা.) সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন: “তারা (শ্রমিকরা) তোমাদের ভাই । আল্লাহ তাদের দায়িত্ব তোমাদের উপর অর্পণ করেছেন। … তোমরা যা খাবে, তাই তাদের খেতে দেবে। যা পরবে তাদেরকে তাই পরতে দেবে । আর যে কাজ করা তাদের পক্ষে কষ্টকর, তা করার জন্য তাদেরকে বাধ্য করবে না।
কাজেই মদিনার সমাজে মজুরদের ভাই বলে গণ্য করা হতো। সেখানে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হতো না। উপরন্তু তাদের তৎকালীন পরিস্থিতিতে পর্যাপ্ত মজুরি প্রদান করা হতো। মজুরি সময়মতো পরিশোধ করা হতো। মজুরি কাজে নিযুক্ত করার পূর্বে নির্ধারিত হতো। এ ব্যাপারে নবী করিমের (সা.) আদেশ হচ্ছে:
ক. মজুরের মজুরি তার ঘাম শুকাবার পূর্বে আদায় কর।
খ. মজুরকে মজুরি নির্ধারণ না করে কাজে নিয়োগ করবে না।
আজকের দিনেও মজুরের মর্যাদা, অধিকার ও স্বার্থরক্ষা করার জন্য ইসলামী সরকারকে বিস্তারিত আইন রচনা করতে হবে, যাতে ইসলামের নির্দেশগুলো সঠিকভাবে পালিত হয় । ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল
এখানে এ কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে যে, যদিও ইসলাম শ্রেণি-সংগ্রাম সমর্থন করে না, তবুও তার অর্থ এ নয় যে সমাজের ভিন্ন স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন শ্রেণির (যেমন বাড়িওয়ালা বনাম ভাড়াটিয়া অথবা মালিক বনাম শ্রমিক) মধ্যে যে স্বাভাবিক সংঘাত রয়েছে, তাকে অস্বীকার করতে ইসলাম শিক্ষা দেয়।
এ ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, এসব সংঘাতের মধ্যে ইনসাফ সহকারে মীমাংসা করে দেয়া। কুরআন মজীদে বলা হয়েছে:
যখন বিশ্বাসীদের মধ্যে দুই দল সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন তাদের মধ্যে ইনসাফের ভিত্তিতে মীমাংসা করে দাও।
(সূরায়ে হুজরাত: আয়াত ৯)
করব্যবস্থা
মদিনার অর্থনীতিতে ওশর, খারাজ, যাকাত, বাণিজ্যশুল্ক এগুলো ছিল প্রধান সরকারি আয়। মুসলমানদের অধিকারভুক্ত জমিতে উৎপন্ন ফসলের যাকাতকে ওশর বলা হয় । বৃষ্টি বা ঝর্ণায় সিক্ত ভূমি হতে ফসলের এক-দশমাংশ ও যেসব জমিতে অন্যভাবে সেচ দিতে হয় তা থেকে বিশ ভাগের একভাগ ফসল ওশর হিসেবে নেয়া হতো। ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল
অমুসলিমদের মালিকানা ও ভোগাধিকারভুক্ত জমি হতে খারাজ আদায় করা হতো । জমির গুণাগুণ ও উর্বরতার ভিত্তিতে খারাজ নির্ধারণ করা হতো ৷ নগদ অর্থ, ব্যবসাপণ্য, স্বর্ণ-রৌপ্য, প্রয়োজনাতিরিক্ত পশু ইত্যাদি সম্পদের উপর হতে যাকাত আদায় করা হতো ৷ ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল
মদিনার অর্থনীতিতে যাকাত ও অন্যান্য খাত হতে পর্যাপ্ত আয় হতো এবং তাতে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও সামরিক ব্যয়ের চাহিদা মিটে যেত, তাই এসব খাতে অতিরিক্ত কর ধার্য করার কোনো প্রয়োজন তখন দেখা দেয়নি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে এসব খাতে অতিরিক্ত কর ধার্য করার অধিকার ইসলামী সরকারের রয়েছে ।
হযরত ওমর ফারুক (রা.) আমদানি পণ্যের উপর শুল্ক ধার্য করেছিলেন।’ পরবর্তী ইমামরাও যেমন ইমাম শাতিবী ও ইমাম ইবনে হাজম সরকারের অতিরিক্ত কর ধার্য করার আইনগত অধিকার স্বীকার করেছেন।
মদিনার অর্থনীতির উপর কড়া নজর রাখা হতো যাতে আদল-ইনসাফ কায়েম থাকে ও কোনো জুলুম হতে না পারে। আল মাওয়ার্দী তাঁর বিখ্যাত বই ‘আল-আহকামুস সুলতানীয়া তে লিখেছেন, “ইসলামী সরকারের অন্যতম দায়িত্ব মারুফকে কায়েম করা ও মুনকারকে বন্ধ করে দেয়া।
এ হচ্ছে একটি সামগ্রিক ফরয, যা জীবনের প্রতিটি দিকের সাথে সম্পর্কিত। এ ফরয আদায় করার জন্য ইসলামী সরকারসমূহ বিশেষ ব্যবস্থা করে থাকে এবং ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ইসলামী সরকারসমূহ ‘হিসবা’ নামে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান কায়েম করেছিল।
হযরত ওমর ফারুক (রা.) এ কাজ নিজেই করতেন। তিনি বাজারের উপর সর্বক্ষণ নজর রাখার জন্য আবদুল্লাহ বিন ওতবাকে নিয়োগ করেছিলেন।
কাজেই স্পষ্টই প্রমাণিত হচ্ছে যে, মদিনার অর্থনীতির উপর সব সময়ই কড়া নজর রাখা হতো এবং কোনো অবিচার যাতে না হতে পারে তা নিশ্চিত করা হতো। হযরত ওমর (রা.) একবার বাজারে নিজে পানি মেশানো দুধ দেখতে পেয়ে তা মাটিতে ঢেলে দিয়েছিলেন যাতে ভেজাল প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
ওপরে মদিনা ও আরব দেশে কায়েম করা ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেলটির চিত্র তুলে ধরা হলো । আজকের যুগেও নতুন করে ইসলামী অর্থনীতি গড়ে তুলতে হলে তার মূলনীতি মদিনার মডেল থেকে গ্রহণ করতে হবে। এ অর্থনীতি কুরআনের আলোকে রসূলুল্লাহ (সা.) ও মহান খোলাফায়ে রাশেদার হাতে গড়ে উঠেছিল। ইসলামী অর্থনীতির প্রথম মডেল
তাঁদের চেয়ে বেশি ভালো করে কেউ ইসলামকে বুঝতে পারেন না বা তাদের চেয়ে বেশি ইনসাফ ও জনকল্যাণ করার কথা কেউ ধারণাও করতে পারেন না, ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি ও তার প্রতিষ্ঠা করার যারা চিন্তা করেন তাদের একথা মনে রাখতে হবে।
- আরো পড়ুন : ইসলামী অর্থনীতি ও তার বাস্তবায়ন