অর্থনীতিতে ইসলামী সরকারের ভূমিকা আলোচনার পূর্বে ইসলামী অর্থনীতির উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা প্রয়োজন। কেননা এর উপরেই নির্ভর করে অর্থনীতিতে সরকার কি ভূমিকা নেবে।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
ইসলামী অর্থনীতির (প্রকৃতপক্ষে গোটা ইসলামী জীবনব্যবস্থা বা বিধানের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ‘আদল’ ও ‘ইহসান’ কায়েম করা। এ সম্পর্কে কুরআন পাকের ঘোষণা হচ্ছে:
আল্লাহ তোমাদের আদল, ইহসান ও নিকট লোকদের অধিকার আদায়ের আদেশ দিচ্ছেন ও অশ্লীলতা, দুর্নীতি ও অবাধ্যতা নিষেধ করেছেন।
(সূরা নহল: আয়াত ৯০)
আদল ও ইহসানকে সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠা করার কথাই আল্লাহপাক বলেছেন। কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এই আদল ও ইহসানকে (সুকার্যক্রম বা good conduct) প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার অর্থ হচ্ছে সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক জুলুমের পন্থাকে নিষিদ্ধ করে দেয়া ও এমন সব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যাতে দেশের ভেতরে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, শ্রেণিতে শ্রেণিতে, অঞ্চলে অঞ্চলে সুবিচার কায়েম হয়।
আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুবিচারের অর্থ হবে এক রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের শোষণ বন্ধ করা। আজকাল উন্নত রাষ্ট্রসমূহ দরিদ্র দেশসমূহকে কাঁচামালের কম দাম দিয়েও শিল্পজাত দ্রব্যের উচ্চ দাম আদায় করার মাধ্যমে শোষণ করে থাকে। শোষণের আরো অনেক উপায় আছে।
ইসলামী অর্থনীতির সার্বিক উদ্দেশ্য হচ্ছে, সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা । এটিই প্রধান বিষয় এবং কোনো যুক্তিতেই সামাজিক সুবিচারের মূলনীতিকে ক্ষুণ্ণ করা যাবে না।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
ইসলামী অর্থনীতির অন্যান্য লক্ষ্য যেমন সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার, জীবিকা অর্জনের স্বাধীনতা, বঞ্চিতদের অর্থনৈতিক প্রয়োজন মিটানো ও মানবিক মর্যাদার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার কায়েম করা।
কাজেই অন্যসব অর্থনৈতিক বিবেচনাকে সামাজিক সুবিচার মূলনীতির অধীনস্থ মনে করতে হবে এবং সত্যিকার অর্থে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিচার ব্যাহত করে এমন কোনো অর্থনৈতিক নিয়ম বা নীতিকে কার্যকর থাকতে দেয়া কিছুতেই বৈধ হতে পারে না।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
সুবিচার এবং সুকার্যক্রম প্রতিষ্ঠার যে আদেশ আল্লাহপাক দিয়েছেন তা ইসলামী সরকারসহ প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর ফরয। এ ফরয পালন করা থেকে কোনো মুসলমান বা সরকার অব্যাহতি পেতে পারে না। এছাড়া আল্লাহপাক স্পষ্টভাবে কুরআন মজীদে ইসলামী সরকারের ভূমিকা এভাবে উল্লেখ করেছেন:
তাদেরকে পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করা হলে তারা নামাজ কায়েম করে, যাকাত দান করে, সুনীতির প্রতিষ্ঠা করে ও দুর্নীতির প্রতিরোধ করে।
(সূরা তওবা: আয়াত ৭১)
এ আয়াতে আল্লাহপাক মারুফের প্রতিষ্ঠা ও মুনকারের প্রতিরোধের কথা বলেছেন । আদল ইহসান করতে হলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মারুফকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং মুনকারকে প্রতিরোধ করতে হবে। মারুফ বা সুনীতি ও মুনকার বা দুর্নীতি শব্দ দু’টি অত্যন্ত ব্যাপক এবং নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সবক্ষেত্রেই এটি সক্রিয় রয়েছে।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে ‘আমরু বিল মারুফ’ এর সঠিক প্রয়োগের অর্থ হবে সর্ববিধ উপায়ে সুবিচারমূলক অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং ‘নাহি আনিল মুনকার’ এর অর্থ হবে অর্থনৈতিক জুলুমের সব উপায় ও পন্থাকে বন্ধ করে দেয়া।
অর্থনৈতিক সুবিচার কায়েম ও জুলুমের অবসানের জন্য রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় সব আইন রচনা করতে পারে এবং তার প্রয়োজনীয় আইনগত ক্ষমতা কুরআনের এ আয়াতে ইসলামী সরকারকে প্রদান করা হয়েছে।
অবশ্য কি ধরনের অর্থনৈতিক পন্থা ও উপায়কে জুলুম বলে গণ্য করা হবে তা নির্ভর করবে শরিয়তের ভিত্তিতে গঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তের উপর। পার্লামেন্টের এ ক্ষমতা ব্যক্তি স্বাধীনতার অজুহাতে খর্ব করা যেতে পারে না।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে ইসলামী সরকার সব ধরনের মুনাফাখোরী, মজুতদারী, কার্টেল, মনোপলী, চোরাচালান ও অন্য সব অন্যায় পন্থা বন্ধ করে দিতে পারে । এসব বন্ধ করে দেয়ার জন্য আইন তৈরি করা সরকারের জন্য অপরিহার্য।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
অন্যদিক থেকে বিচার করলেও আমরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামী সরকারের ক্ষমতা সম্পর্কে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবো। ইসলামী আইন রচনার তিনটি ভিত্তি হচ্ছে – কুরআন, সুন্নাহ ও ইজতিহাদ। ইজতিহাদ করার বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে।
কিয়াস বা অনুমিত সিদ্ধান্ত ( Systematic inference) হচ্ছে ইজতিহাদের অন্যতম পদ্ধতি। ইজতিহাদের অন্য উল্লেখযোগ্য নীতি ইসতিহসান বা ইসতিসলাহ অর্থাৎ আইনের এমন ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করা যাতে জনগণের মঙ্গল ও সুবিধা হয়।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
এখন দেখা যেতে পারে যে, শরিয়তে কেন সুদ ও জুয়াকে হারাম করা হলো, কেন যাকাতকে ফরয করা হলো এবং কেন বা অর্থ যেন ধনীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে সে ব্যাপারে সতর্ক করা হলো?ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
স্পষ্টতই আল্লাহপাক সুদ ও জুয়াকে সমাজের জন্য অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অত্যন্ত ক্ষতিকর মনে করেই নিষিদ্ধ করেছেন। তেমনিভাবে যাকাতকে সমাজের জন্য অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কল্যাণকর হওয়ার কারণেই ফরয করেছেন।
এ থেকে স্পষ্ট কিয়াস করা যায় যে, আল্লাহ পাক ক্ষতিকর অর্থনৈতিক নিয়ম ও পন্থাকে অপছন্দ করেন এবং সমাজের জন্য কল্যাণকর অর্থনৈতিক পন্থাকে পছন্দ করেন।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
কাজেই কিয়াসের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে, সমাজ ও ইসলামী সমাজের দায়িত্ব হলো ক্ষতিকর অর্থনৈতিক উপায় ও পন্থাকে উৎখাত করা এবং সমাজের পক্ষে কল্যাণকর অর্থনৈতিক উপায় ও পন্থাকে উৎসাহিত ও প্রতিষ্ঠিত করা।
শরিয়ত ও ইসলামী আইনের লক্ষ্য সম্পর্কে ইমাম ইবনে কাইয়্যেমের মত এখানে উল্লেখ করা হলো:
আল্লাহতায়ালার নবী পাঠানো ও কিতাব নাজিল করার উদ্দেশ্য ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা যা হচ্ছে গোটা সৃষ্টির মূলনীতি । আল্লাহর নাজিল করা প্রতিটি বিষয় এ কথাই প্রমাণ করে যে, এসবের সত্যিকার উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্য ও ইনসাফ এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা।
যেভাবেই আইন রচনা করা হোক না কেন আইনকে সত্য ও ইনসাফের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আইনের আসল লক্ষ্য কিভাবে আইন পাওয়া গেল তা নয়। কিন্তু আল্লাহ আমাদের কিছু আইন দিয়ে কতকগুলো উদাহরণ স্থাপন করেছেন এবং আইনের কয়েকটি যুক্তিসংগত ভিত্তি দিয়েছেন ।
আমরা তাই ন্যায়সংগত সরকারি নীতি ও আইনকে শরীয়তের অংশ মনে করি। শরীয়তের বরখেলাপ হওয়া মনে করি না। এসবকে রাজনৈতিক নীতি বলা কেবল পরিভাষার ব্যাপার। আসলে এগুলো শরীয়তেরই অংশ, তবে শর্ত এই যে, এগুলিকে ইনসাফের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।’ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
এই উদ্ধৃতিটি বর্তমানকালে ইসলামী আইন রচনা প্রসঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী রাষ্ট্র কর্তৃক তৈরি করা আইনের ধর্মীয় প্রকৃতি এ থেকে প্রমাণিত হয় । আরো একদিক থেকে আমরা ইসলামী অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা পর্যালোচনা করতে পারি।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
শরীয়তের পরিভাষায় ‘ফরজে কেফায়া’ বলা হয় সে সব সামাজিক ফরজকে যা নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর ফরজ নয়, কিন্তু যা সমাজকে অবশ্য করতে হয়। এ সম্পর্কে ইমাম শাতিবি লিখেছেন:
ফরজে কেফায়া’র অর্থ – এগুলি নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর ফরজ নয়। এগুলি গোটা সমাজের দায়িত্ব। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ঐ সব সাধারণ জনকল্যাণকর কাজগুলি অব্যাহতভাবে হতে থাকার অবস্থা করা যার অবর্তমানে ব্যক্তিস্বার্থও নিরাপদ থাকে না। এগুলি পূর্বে উল্লিখিত ব্যক্তিগত ফরজগুলিকে পূর্ণ ও শক্তিশালী করে।
কাজেই এগুলি অত্যন্ত জরুরি কাজ। ফরজে কেফায়াগুলি সব মানুষের কল্যাণের জন্য। এজন্যই এসব দায়িত্ব ব্যক্তির উপর ছেড়ে দেয়া হয়নি, কারণ তাহলে এগুলি ব্যক্তিগত ফরজে পরিণত হতো।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
কিন্তু ব্যক্তির পক্ষে তার নিজের সব দায়িত্বই সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব হয় না, পরিবার, আত্মীয়স্বজন, সমাজ ও সাধারণ মানুষের কথা তো অনেক বড় ব্যাপার। সে জন্যই আল্লাহতায়ালা সাধারণ স্বার্থ সংক্রান্ত বিষয়গুলোর দায়িত্ব সমাজের উপর অর্পণ করেছেন। এটাই সমাজ ও রাষ্ট্রের অস্তিত্ত্বের ভিত্তি।`
জিহাদ, ইসলামের প্রচার, সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শিল্প ও সেবা ‘ফরজে কেফায়া’র অন্তর্ভুক্ত।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, “শাফিয়ী ও হামবলী ফিকাহর অনুসারী অনেক ফকীহ এবং গাজ্জালী ও আলজওজীর মতে এসব শিক্ষা হচ্ছে ‘ফরজে কেফায়া’, কেননা (জাতির অর্থনৈতিক জীবন এসব শিক্ষা ছাড়া চলতে পারে না ।”” কাজেই দেখা যাচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সেবা ও শিল্পগুলো কায়েম রাখা সমাজ ও সরকারের দায়িত্ব।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে ক্ষমতা ও অধিকার প্রয়োজন, উপরের আলোচনা হতে প্রমাণিত হয় যে, সে ক্ষমতা ইসলামী শরিয়তে সরকারকে দেয়া হয়েছে।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
মুসলিম ফকীহরাও এ মত সমর্থন করেছেন। এ নীতিগত আলোচনার পর বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামনে রেখে ইসলামী সরকারের বাস্তব অর্থনৈতিক ভূমিকা কি হতে পারে তা নির্ধারণ করা যেতে পারে।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
সব মুসলিম দেশেই ইসলামী সরকারের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে শরীয়ত প্ৰদত্ত সব অধিকার হেফাজত করা। ইসলামী শরীয়ত ব্যক্তিকে আয় উপার্জনের অধিকার দান করেছে। কুরআন মজীদে ঘোষণা করা হয়েছে:
আল্লাহ তোমাদের জন্য ব্যবসাকে হালাল করেছেন।
(সূরা আল-বাকারা: আয়াত ২৭৫)
যখন নামাজ শেষ হয়, পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর দেয়া রিজিক অনুসন্ধান কর।
(সূরা জুমুয়া: আয়াত ১০)
ওপরের আয়াত দু’টি হতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, কর্মের স্বাধীনতা (Freedom of work and enterprise ) ইসলামের একটি বুনিয়াদী নীতি ।
ইসলামে কেবল কর্মের স্বাধীনতা দেয়া হয়নি বরং জীবিকার জন্য কাজ করাকে ফরজ করা হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না ঐ অধিকারকে অপব্যবহার করা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা রক্ষা করা ইসলামী সরকারের কর্তব্য।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
তেমনিভাবে জায়েজ পথে অর্জিত ধন-সম্পদ এবং ইসলামী উত্তরাধিকার আইন বলে পাওয়া ধন-সম্পদ নিজের কর্তৃত্বাধীনে রাখা ও ভোগ-দখল করার অধিকার প্রত্যেক ব্যক্তিকে ইসলাম দান করেছে। কুরআন মজীদে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে:
তোমাদের মাল একে অপরে অন্যায়ভাবে খেয়ো না।
(সূরা আল-বাকারা: আয়াত ১৮৮, সূরা নিসা: আয়াত ২৯)
পুরুষগণ যা উপার্জন করে তা তাদের এবং স্ত্রীলোকগণ যা উপার্জন করে তা তাদের।
(সূরা নিসা: আয়াত ৩২)
কুরআন পাকে আরো বলা হয়েছে,
তারা কি চিন্তা করে না যে আমি আমার ক্ষমতায় তাদের জন্য জন্তু- জানোয়ার সৃষ্টি করেছি, যেসবের তারা মালিক হয়ে থাকে ।
(সূরা ইয়াসিন: আয়াত ৭১)
এ আয়াতে আল্লাহপাক মানুষের জন্য ‘মালিক’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অবশ্য মানুষ কখনো নিরঙ্কুশ মালিক হতে পারে না। নিরঙ্কুশ মালিকানা হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর । কেননা কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থানে ঘোষণা রয়েছে যে, আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর মালিক হচ্ছে আল্লাহ।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
কাজেই মানুষের অধিকার হচ্ছে আমানতী মালিকানার। মানুষ আল্লাহর খলিফা হিসেবে আমানতদার মাত্র। আল্লাহর আদেশ-নির্দেশের অধীনেই তাকে তার ধন-সম্পত্তি ভোগ-ব্যবহার করতে হবে । ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার প্রত্যেক ব্যক্তির ও প্রতিষ্ঠানের আমানতী মালিকানার অধিকার সংরক্ষণ করবে।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
অবৈধ সম্পত্তি
নাজায়েজ পন্থায় জুলুম করে অর্জিত সম্পত্তি রক্ষা করা ইসলামী সরকারের দায়িত্বের অংশ নয়। বরং অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ ইসলামী সরকার বাজেয়াপ্ত করে নেবে। কেননা সব অবৈধ পন্থাই হচ্ছে হারাম ও মুনকার, আর মুনকার নির্মূল করা হচ্ছে ইসলামী সরকারের প্রধানতম দায়িত্ব।
অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে নেয়ার অথবা তার মূল মালিকদের নিকট ফিরিয়ে দেয়ার অনেক নজির ইসলামী ইতিহাসে রয়েছে।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
যেসব শাসনকর্তা তাদের সরকারি পদের সুযোগ নিয়ে বিত্ত-সম্পত্তি করেছিলেন তাদের সম্পত্তির এক অংশ হযরত ওমর (রা.) বাজেয়াপ্ত করেছেন। এ কারণে তিনি একবার ওমর বিন আল আস ও সা’দ বিন আবী ওয়াককাসের অর্ধেক মাল বাজেয়াপ্ত করেন।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
হযরত ওমর বিন আব্দুল আজিজ (রা.) ক্ষমতা গ্রহণ করার পর বনি উমাইয়ার লোকেরা অন্যদের যেসব জমাজমি ও সম্পদ জোরজবরদস্তি করে বা অবৈধ উপায়ে দখল করে নিয়েছিল তা তাদের নিকট থেকে কেড়ে নিয়ে মূল মালিকদের নিকট ফিরিয়ে দেন।
ইমাম আবু ইউসুফ বলেন, ‘আমার এক শিক্ষক আমাকে বলেছেন যে, ওমর বিন আব্দুল আজিজের নজর সবসময় অন্যায়ভাবে দখলীকৃত সম্পদ তার সত্যিকার মালিকদের নিকট ফিরিয়ে দেয়ার প্রতি নিবদ্ধ ছিল।
কাজেই ইসলামী সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হবে অবৈধ সম্পত্তি উদ্ধার করে তার সত্যিকার মালিকদের নিকট ফিরিয়ে দেয়া অথবা বায়তুল মালে জমা রাখা । এজন্য অতীতে ‘হিসবা’ নামে একটি দফতর কায়েম করা হয়েছিল।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
আজও মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান কায়েম করতে হবে। এ বিভাগের দায়িত্ব দিতে হবে অত্যন্ত সচ্চরিত্র উচ্চপর্যায়ের লোকদের হাতে। কোনো সাধারণ বিভাগের পক্ষে এ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয় ।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
যাদের হাতে সীমাতিরিক্ত অর্থ-সম্পদ রয়েছে তাদের সম্পদ জায়েজ পথে অর্জিত হয়েছে কিনা তা দেখা এ বিভাগের বিশেষ কর্তব্য হবে। ইসলামের দেয়া কর্ম ও জীবিকা অনুসন্ধানের স্বাধীনতার অর্থ এ নয় যে, সমাজের জন্য ক্ষতিকর ব্যবসা করা যাবে।
তা কখনো হতে পারে না। কেননা ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে সমাজের জন্য ক্ষতিকর কোনো কাজই জায়েজ হতে পারে না। এগুলো সবই মুনকারের পর্যায়ভুক্ত। এগুলো নির্মূল করা সরকারের কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ধোঁকাবাজি করে সে আমার তরীকার লোক নয় ।
এর উপর ভিত্তি করে সাইয়েদ কুতুব বলেছেন, “ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্য কারবারের মধ্যে ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা সম্পূর্ণভাবে হারাম ঘোষণা করেছে।”
সাইয়েদ মওদূদী বলেছেন, ‘সামগ্রিক স্বার্থের পক্ষে ব্যবসায়ের যেসব নিয়মপন্থা মারাত্মক ও ক্ষতিকর তা সবই আইনত বন্ধ করে দেয়া আবশ্যক।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
মজুতদারি
ইসলামী সরকারকে সব অবৈধ-অন্যায় ব্যবসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব ব্যবস্থা জনগণের খুব বেশি ক্ষতি করে থাকে তার মধ্যে মজুতদারি অন্যতম । মজুতদার স্বাভাবিক ব্যবসায়ী নয়। স্বাভাবিক ব্যবসায়ী মাল কিনে ও বিক্রি করে স্বাভাবিক মুনাফা করে থাকে।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
কিন্তু মজুতদার পণ্য কিনে বহুদিন ধরে আটকে রাখে যাতে বাজারে দুষ্প্রাপ্যতা সৃষ্টি হয় ও মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। মজুতদারির ফলে দ্রব্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায় । অনেক সময় দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়। ফলে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করে । নবী করিম (সা.) বলেছেন: ‘যে ইহতিকার করল সে অপরাধী।
‘ইহতিকার’ অর্থ অধিক লাভের আশায় পণ্য মজুত রাখা। খাদ্য দ্রব্যের ইহতিকার করতে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিষেধ করেছেন। কাজেই ইসলামী সরকার মজুতদারকে শক্ত হাতে দমন করবে। এজন্য প্রয়োজনীয় আইন রচনা করতে হবে।
যদি আগে হতে আইন থেকে থাকে তবে তা যথাযোগ্যভাবে সংশোধন ও প্রয়োগ করতে হবে। অবশ্য আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন স্বাভাবিক মজুত ব্যবসায়ে কোনো অসুবিধা না হয়।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
এজন্য আইনে এমন ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে যার অধীনে ব্যবসায়ী কোনো মাল সর্বোচ্চ কত পরিমাণ কত দিন ধরে রাখতে পারবে, সময়ে সময়ে সরকার তা নির্ধারণ করে দেবেন। যেমন, কৃষিপণ্য ফসল উৎপাদনের সময় অধিক পরিমাণ বেশি দিন ধরে রাখার অনুমতি দেয়া যেতে পারে।
আবার যে সময় এ দ্রব্য কম পাওয়া যায় সে সময় মজুতের সময় ও পরিমাণ কমিয়ে দেয়া যেতে পারে। আমদানি ও শিল্পজাত দ্রব্যের ব্যাপারে তেমনিভাবে মজুতের সময় ও পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে। আমদানি এবং উৎপাদনের পরিমাণ ও বিক্রি মূল্য পত্রিকায় নিয়মিত ঘোষণা করতে বাধ্য করা যেতে পারে।
ক্রেতারা কিনতে চাইলে এসব উৎপাদন ও আমদানি দ্রব্য যাতে আমদানিকারক ও উৎপাদক বিক্রি করতে বাধ্য থাকে, আইনে তার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। মজুতদারি বন্ধ করার জন্য সরকার অন্যসব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
মুনাফাখোরী
ইসলামী শিক্ষার আলোকে ন্যায়সংগত মুনাফা হচ্ছে সেই মুনাফা,
ক. যা সাধারণ অবস্থায় স্বাভাবিক বাজারের (Market) চাহিদা ও যোগানের নিয়ম অনুযায়ী পাওয়া যায়। অর্থাৎ যে অবস্থায় চাহিদা বা যোগানকে অস্বাভাবিকভাবে প্রভাবিত করা হয় না।
খ. যা মিল-কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা ক্ষেতে-খামারে কর্মরত শ্রমিকদের ন্যায়সংগত মজুরি দেয়ার পর পাওয়া যায়।
গ. যা ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার খেয়াল রেখে অর্জন করা হয়।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
এ ধরনের মুনাফাকেই ন্যায়সংগত মুনাফা বলা যেতে পারে। কাজেই যেসব ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি চাহিদা ও যোগানকে অস্বাভাবিকভাবে প্রভাবিত করে, শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ও ক্রেতাদের শোষণ করে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে চায়, সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
নানাভাবে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার রক্ষা করার জন্য সরকার আইন প্রণয়ন করবে এবং তা মানতে মালিক ও ব্যবসায়ীদের বাধ্য করবে। দোকান কর্মচারী ও শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা করার জন্য এখনো নানা আইন রয়েছে।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
এগুলোকে বাস্তবতা, ইনসাফ ও প্রয়োজনের আলোকে সংশোধন ও শক্তিশালী করা যেতে পারে। দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনার জন্য সরকার স্বাভাবিক অর্থনৈতিক নিয়মসমূহের সুযোগ গ্রহণ করবেন।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব না হলে বিদেশ হতে আমদানি বৃদ্ধি করে সরবরাহ বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে। দেশে মালপত্রের অভ্যন্তরীণ চলাচলের উপর বিধিনিষেধ খুবই কম রাখতে হবে, কেননা এতে নানা অঞ্চলে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি হয় ও দুর্নীতির অবকাশ বৃদ্ধি পায় ।
ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ
অবশ্য এ সবেও কাজ না হলে ইসলামী সরকারকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জনগণের কষ্ট ও তাদের উপর জুলুম বন্ধ করা সরকারের অপরিহার্য দায়িত্ব। স্বাভাবিক অবস্থায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা ইসলামের নীতি নয়, কেননা ইসলাম স্বাভাবিক ও স্বাধীন অর্থব্যবস্থা পছন্দ করে যতক্ষণ পর্যন্ত না তাতে কোনো জুলুম হয়।
কিন্তু যদি ব্যবসায়ীরা অন্যায়ভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে এবং তাতে জনগণের অসহনীয় কষ্ট হয় তবে দ্রব্যমূল্য বেঁধে দিতে হবে। এ সম্পর্কে কয়েকজন মনীষীর মত উল্লেখ করা হলো:
বিশেষ অবস্থায় দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের অধিকার রাষ্ট্রের রয়েছে এবং এ অধিকারের বুনিয়াদ শরীয়তের এই নীতি যে, জনগণের অসুবিধা দূর করা অপরিহার্য।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া তার ‘আল হিসবা ফিল ইসলাম’ বইতে কোন কোন অবস্থায় মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
তার আলোচনা তিনি সমাপ্ত করেছেন এভাবে, “যদি স্বাভাবিকভাবে সাধারণ মানুষের প্রয়োজন পূরণের জন্য মূল্য ন্যায়সংগত পর্যায়ে নির্ধারিত না হয় তবে জনগণের জন্য ইনসাফের ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হবে, কমও নয়, বেশিও নয়।
ফিকাহর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হিদায়া’তে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘জনগণকে নিয়ন্ত্রিত মূল্যের অধীন করে দেয়া সরকারে জন্য ঠিক নয়, কেননা নবী করিম (সা.) বলেছেন, মূল্য নিয়ন্ত্রণ করবে না, কেননা আল্লাহ মূল্য নির্ধারণ করে থাকেন, সংকীর্ণতা ও প্রশস্ততা সৃষ্টি করে থাকেন এবং রিজিক দিয়ে থাকেন।
কাজেই বাজারের মূল্য নির্ধারণ করা ক্রেতা ও বিক্রেতার কাজ । সরকারের এতে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। একমাত্র জনগণের অসুবিধা দূর করার জন্যই তা করা যেতে পারে ৷’ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
‘আল্লাহ মূল্য নির্ধারণ করে থাকেন’ অর্থ চাহিদা ও যোগানের স্বাভাবিক নিয়মে (Market forces) তা নির্ধারিত হয়ে থাকে। এ হাদিসটি সম্পর্কে ইমাম তাইমিয়া বলেছেন, “যে ব্যক্তি মূল্য নির্ধারণ সম্পর্কে নবী (সা.)-এর হাদিস থেকে এ ব্যাখ্যা করেন যে, মূল্য নির্ধারণ ছিল সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ, তিনি ভুল করেন।
কেননা এটা ছিল একটি বিশেষ অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত আদেশ, সাধারণ আদেশ ছিল না। এই হাদিসে একথা বলা হয়নি যে, কোনো ব্যক্তি এমন কোনো দ্রব্য বিক্রি করতে অস্বীকার করেছিল কিনা যা বিক্রি করতে সে বাধ্য ছিল অথবা এমন কোনো কাজ করতে অস্বীকার করেছিল যা করা তার উপর ওয়াজিব ছিল অথবা সে স্বাভাবিক মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত দাবি করেছিল ।
মূল হাদিসটি হচ্ছে এই: নবী করিম (সা.)কে এক ব্যক্তি বলেছিল যে, মূল্য নির্ধারণ করে দিন। নবী (সা.) বললেন, মূল্য নির্ধারণ আল্লাহর কাজ, তিনিই সংকীর্ণতা ও প্রশস্ততা সৃষ্টি করেন ও রিজিক দিয়ে থাকেন। আমি খোদার কাছে এমনভাবে যেতে চাই যেন কারো হক আমার কাছে পাওনা না থাকে।
এ সম্পর্কে শাহ ওয়ালীউল্লাহ বলেন, “আমি বলি যে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে এমন ইনসাফ ‘যাতে কারো ক্ষতি না হয় অথবা সমান ক্ষতি হয়’ কায়েম করা কষ্টকর ছিল।
এজন্য নবী (সা.) এ সতর্কতা অবলম্বন করেন যাতে শাসকরা (মূল্য নির্ধারণকে) সাধারণ নিয়মে পরিণত না করে ফেলেন। এ সত্ত্বেও যদি ব্যবসায়ীদের পক্ষ হতে প্রকাশ্য জুলুম হয় যা সব সন্দেহ হতে মুক্ত, তবে তা বন্ধ করা জায়েজ, কেননা এতে দেশের ধ্বংস নিহিত।
কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, সামাজিক স্বার্থরক্ষা ও ইনসাফ কায়েম রাখার জন্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের কর্তব্য, এ কথা ইসলামের বহু পণ্ডিতই ব্যক্ত করেছেন।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
মনোপলি ও কার্টেল
আজকাল শিল্পপতিরা মনোপলি ও কার্টেল কায়েম করে তার মাধ্যমেও জনগণকে শোষণ করে থাকে। যদি উৎপাদনের উপর উৎপাদকের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকে তবে তাকে মনোপলি বা একচেটিয়া কারবার বলে।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
যদি উৎপাদনের উপর মাত্র কয়েকজনের নিয়ন্ত্রণ থাকে তাতেও একচেটিয়া কারবারের অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। যখন উৎপাদকরা সমিতিবদ্ধ হয়ে উৎপাদন, মূল্য ও বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে, সে অবস্থাকে কার্টেল বলে।
মনোপলির কিছু ভালো দিকও আছে। এতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে এবং উৎপাদন খরচও কম হতে পারে। কার্টেলের কিছু অর্থনৈতিক সুবিধা হয়ত আছে, কিন্তু সাধারণভাবে এ যুগে একে ক্রেতা ও জনগণকে শোষণ করতে ব্যবহার করা হয়। উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি করা হয়।
অধিকাংশ সময় উৎপাদন খরচের সাথে সংগতি না রেখে অস্বাভাবিক মূল্যে জনগণকে মাল কিনতে বাধ্য করা হয়। এসব যে স্পষ্ট জুলুম তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অবশ্য সরকারি খাতে যেসব মনোপলি রয়েছে তাদের কথা স্বতন্ত্র। সে সব ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি বা জনগণকে শোষণের প্রশ্ন ওঠে না।
কাজেই সরকারি মনোপলি ছাড়া অন্য সব মনোপলি ও কার্টেলকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য শক্ত আইন করতে হবে এবং প্রয়োজন হলে বর্তমান আইনসমূহকে আরো শক্তিশালী করতে হবে।
তেমনিভাবে অন্যান্য অবৈধ ব্যবসাকে (যেমন দ্রব্যে ভেজাল দেয়া) আইন প্রয়োগ করে শক্ত হাতে বন্ধ করতে হবে। আসল কথা, কোনো অন্যায় ও জুলুমমূলক এবং প্রবঞ্চণা ভিত্তিক ব্যবসায়ী নীতি চালু থাকতে দেয়া হবে না।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
হিজরের আইন
ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা যদি এসব আইন মেনে না চলে এবং আইন ভঙ্গ করে তবে সরকার তাদের সম্পত্তি সাময়িকভাবে নিজের হাতে নিয়ে নিতে পারে। ইসলামী পরিভাষায় এ ব্যবস্থাকে হিজর বলে । হিজর অর্থ নিরস্ত করা।
শরীয়তের দৃষ্টিতে হিজর অর্থ কোনো ব্যক্তিকে অর্থসম্পদের অপব্যবহার থেকে থামিয়ে দেয়া।* হিজরের আইনের ভিত্তি হচ্ছে কুরআন মজীদের এই আয়াত :
তোমরা তোমাদের মাল নির্বোধ লোকদের উপর ছেড়ে দিও না, কেননা আল্লাহ এ ধন-সম্পত্তি তোমাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করে দাও সে সম্পত্তি হতে এবং তাদের ভালো নীতি শিক্ষা দান কর।
(সূরা আন নিসা: আয়াত ৫)
এ আয়াতে নির্বোধ লোকদের নিকট থেকে তাদের আইনত মালিকানাধীন সম্পত্তি নিয়ে নেয়ার অধিকার সমাজকে দেয়া হয়েছে। অবশ্য সমাজের পক্ষ থেকে এ অধিকার সরকারই পালন করবে। ইসলামী আইন শাস্ত্রের দৃষ্টিতে নির্বোধ বলতে কেবল অবুঝ ও নাবালেগ ব্যক্তিকেই বুঝায় না।
যারা মাল বরবাদ করে, জুলুমের জন্য ব্যবহার করে অথবা অনৈতিক কাজে ও অপরাধ বিস্তারে ব্যবহার করে তারাও নির্বোধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
এসব অবস্থায় সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কারখানা, ব্যবসা বা অন্য সম্পত্তি মালিকের হাত হতে সরকারি কর্তৃত্বাধীনে নিয়ে যেতে পারে। অবশ্য হিজর কতদিনের জন্য হবে তা আদালত কর্তৃক নির্ধারিত হওয়া উচিত। হিজর কালে সরকার মালিককে যথোপযুক্ত খোরপোষ দিতে কুরআন মোতাবেক বাধ্য।
কারখানা বা ব্যবসা তার পক্ষ থেকে সরকার পরিচালনা করবে এবং খরচের পর যে লাভ থাকবে তা মালিকের একাউন্টে জমা হবে। অবশ্য হিজর বলবৎ থাকা অবস্থায় মালিক টাকা তুলতে পারবে না।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
এ ব্যবস্থা ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের সব সময় সতর্ক থাকতে বাধ্য করবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে এক নৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনবে । এজন্য অবশ্য হিজর নীতির আলোকে একটি আধুনিক আইন রচনা করে সরকারকে তা আইন পরিষদ কর্তৃক পাশ করিয়ে নিতে হবে। এছাড়া হিজর কার্যকরী করা যাবে না।
শ্রমিকের অধিকার
ইসলামী সরকারের একটি প্রধান কর্তব্য হবে শ্রমিকদের ন্যায়সংগত অধিকার পাওয়ার ব্যবস্থা করা এবং তাদের উপর যাতে জুলুম না হতে পারে তার যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা। নানা দিক দিয়ে এটি বর্তমান কালেও সরকারের বিশেষ নজর দাবি করে ।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
শিল্প, কৃষি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সমাজের এক বিরাট অংশ শ্রমিক ও কর্মচারী হিসেবে কর্মে নিযুক্ত থাকে। বাংলাদেশেও শতকরা ২০ ভাগের মতো কর্মক্ষম জনশক্তি শ্রমিক ও কর্মচারী হিসেবে শিল্প, কৃষি ও ব্যবসায়ে নিযুক্ত আছে।
অপেক্ষাকৃত শিল্পোন্নত মুসলিম দেশ তুরস্ক, মিশর, পাকিস্তান ও ইরানে এ সংখ্যা আরো অধিক হবে। কাজেই সমাজের জনশক্তির এই বিরাট অংশের স্বার্থকে কিছুতেই অবহেলা করা যাবে না।
অন্যদিকে শ্রমিক ও কর্মচারীদের অধিকার নিয়ে যদি মালিকরা ছিনিমিনি খেলে বা মালিকরা যদি যথোপযুক্ত মজুরি না দেয় তাহলে প্রায়ই সমাজে ব্যাপক অশান্তি দেখা দেয়।
এসব ফেতনা-ফাসাদ ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত নিন্দনীয়। কাজেই যাতে সমাজে কোনো কারণে ফেতনা-ফাসাদ না হয় তার দিকে নজর রাখা ও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের জন্য অপরিহার্য। ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
শ্রমিকদের ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি হচ্ছে যে, তারা হচ্ছে ভাই এবং তাদেরকে ভাইয়ের মতো ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে হবে। মজুরি না ঠিক করে কাজে নিয়োগ করা এবং বেকার খাটানো ইসলামে জায়েজ নয়। কাজেই সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যাতে শ্রমিকরা পর্যাপ্ত মজুরি পায়।
এ প্রসঙ্গে এ কথা উল্লেখ করা দরকার যে শ্রমকে অন্যান্য পণ্যের মতো বিবেচনা করা যেতে পারে না এবং বাজার দরের ভিত্তিতে তার মূল্য নির্ধারণ করা কখনো সংগত হবে না। অন্যান্য পণ্যকে যেমন তার মালিক হতে আলাদা করে বিবেচনা করা যেতে পারে, শ্রমকে তেমনিভাবে শ্রমিক হতে আলাদা করা যায় না।
শ্রমিক শ্রমকে আলাদা করে বিক্রি করে অন্য কাজে লিপ্ত হতে পারে না । অপর দিকে শ্রমিকের অনুভূতি রয়েছে যা অন্যান্য পণ্যের নেই। শ্রমের ক্ষেত্রে আসল ব্যাপার হচ্ছে একটি পূর্ণ মানুষের ব্যবহার, কেবল তার শ্রমের ব্যবহার নয় ।
কাজেই শ্রমকে অন্যান্য পণ্য ও যন্ত্রের মতো কেনাবেচা করা যেতে পারে না বা তার অনুভূতিকে অবহেলা করা যেতে পারে না। তার মানবিক প্রয়োজন ও সম্মানকে কিছুতেই ক্ষুণ্ণ করা যায় না। তার যথোপযুক্ত মজুরি ও সম্মান তাকে দিতেই হবে।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
এসব নীতি ও মূল্যবোধকে সামনে রেখে সরকারকে একটি নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে দিতে হবে যা অনুসরণ করতে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা বাধ্য থাকবে। এজন্য সরকারের প্রয়োজন হবে একটি স্থায়ী মজুরি কমিশন নিয়োগ করা।
কেননা, একদল এক্সপার্টের পক্ষেই বাজার দর পর্যালোচনা করে মজুরি কমিশনের সুপারিশকে আইন রচনা করে বা বর্তমান আইন সংশোধন করে কার্যকর করতে হবে। মজুরি কমিশন সব সময় বাজার দর পর্যালোচনা করতে থাকবে।
যখনই বাজার দর বৃদ্ধি পাবে নিম্নতম মজুরির পর্যায়কেও সে সঙ্গে বাড়াতে হবে। বাস্তবতার প্রয়োজনে অবশ্য কমিশন বিভিন্ন শিল্পের জন্য প্রয়োজন হলে বিভিন্ন মজুরি হার নির্ধারণ করতে পারেন।
কেননা ভারি শিল্পের পক্ষে শ্রমিককে যে বেতন দেয়া সম্ভব, ছোট শিল্পের জন্য তা সম্ভব নাও হতে পারে। আবার শিল্পের পক্ষে যে মজুরি দেয়া সম্ভব দোকানের পক্ষে তা দেয়া সম্ভব নাও হতে পারে। ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
বাস্তবতার আলোকেই সরকার মজুরদের অন্যান্য সুবিধাদানের ব্যবস্থা সম্বলিত আইন রচনা করবেন। শ্রমিকদের স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন করার যথাযথ অধিকার ও বাসস্থান, চিকিৎসা, বোনাস ইত্যাদি সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা আইনে থাকতে হবে।
কিন্তু বোনাস কেবল সে শিল্পের পক্ষেই দেয়া সম্ভব, যে প্রতিষ্ঠানে লাভ হয়ে থাকে। লোকসানের সময় বোনাসের প্রশ্ন উঠতে পারে না। তেমনি ছোট শিল্প ও দোকান মালিকদের পক্ষে বাসস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব না হওয়ারই কথা।
কিন্তু বড় শিল্পের পক্ষে ক্রমে ক্রমে শ্রমিকদের বাসস্থানের জন্য কলোনি করা সম্ভবপর হওয়া উচিত। অর্থাৎ বাস্তবতার নিরিখেই সরকারকে শ্রমিক অধিকার সংক্রান্ত আইন রচনা করতে হবে। অবাস্তব আইন কার্যকরী করা যাবে না, তা যত সদুদ্দেশ্যমূলক হোক না কেন।
এসব আইনের উদ্দেশ্য হবে শ্রমিকের সত্যিকার স্বার্থ রক্ষা করা, শিল্প ও ব্যবসার উপরে স্বাভাবিক বোঝা চাপিয়ে দিয়ে অর্থনৈতিক উদ্যোগ নষ্ট করা নয়, কেননা তা অবশেষে বেকারত্ব ডেকে আনবে।
এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, একটি দেশের শ্রমিক সমাজের জীবনযাত্রার মান কৃষক বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারী সমাজ হতে অস্বাভাবিক বেশি হওয়া সম্ভব নয়। একটি মুসলিম দেশ যতদিন পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে উন্নত না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত কোনো শ্রেণির জীবনমানই বাঞ্ছিত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
ইসলামী সরকারকে তাই সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে উন্নত করার জন্য সর্বপ্রকার উদ্যোগ নিতে হবে এবং সেজন্য আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা, সংগঠন, পরিকল্পনা পদ্ধতি ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
কিন্তু তা হবে ইসলামী সরকারের সুদূরপ্রসারী কর্মসূচি । একই সঙ্গে প্রত্যেকটি মুসলিম সরকারকে তার দেশে বর্তমানে শ্রমিক সমাজ যেসব শোষণ ও জুলুমের শিকার হচ্ছে তার প্রতিবিধান করতে হবে।
জুলুমের প্রতিবিধান
বিভিন্ন দেশে শ্রমিক সমাজ নানাভাবে বঞ্চিত ও শোষিত হচ্ছে। প্রথমে শিল্প শ্রমিকের কথাই ধরা যাক। আজও শিল্প শ্রমিকের চাকরির নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। সামান্য কারণে বা ট্রেড ইউনিয়ন কার্যে অংশগ্রহণ করার জন্য তার চাকরি চলে যায়।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
তাই শ্রমিকের কর্মের নিরাপত্তা সম্পর্কিত আইনকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। শ্রম আদালতের এখতিয়ার ব্যাপক হওয়া উচিত মালিকরা যাতে সহজে ‘লে-অফ’ করে শ্রমিকদের বঞ্চিত করতে না পারে তার ব্যবস্থা আইনে রাখতে হবে।
উপযুক্ত কারণ ছাড়া কিছুতেই ‘লে-অফ’ করতে দেয়া উচিত নয়, কেননা তাতে উৎপাদনও হ্রাস পায়। ‘লে-অফ’-এর বিরুদ্ধে শ্রমিক ইউনিয়ন কর্তৃক শ্রম আদালতে মামলা করার অধিকার থাকতে হবে এবং এসব ক্ষেত্রে যাতে শ্রম আদালত সাত দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করে তার বিধানও আইনে থাকা উচিত।
তেমনিভাবে বোনাস না দিয়ে শ্রমিক সমাজকে যাতে মালিকরা বঞ্চিত না করতে পারে তার ব্যবস্থাও থাকা দরকার। যেহেতু লাভের উপর বোনাস নির্ভর করে, তাই মালিক যেন অপব্যয় ও হিসাবের কারচুপি করে লোকসান না দেখাতে পারে তার ব্যবস্থাও করা দরকার।
অনেক সময় মালিকরা কারখানা হতে অতিরিক্ত ভাতা, যাতায়াত ও অন্যান্য খরচ নিয়ে কারখানার খরচ বৃদ্ধি করে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত লোকসান দেখিয়ে শ্রমিকদের বোনাস থেকে বঞ্চিত করে থাকে। বিষয়টি সরকারকে ভালো করে পর্যালোচনা করতে হবে। ভাতা খুবই যুক্তিসংগত পর্যায়ের হওয়া উচিত।
এসবকে কিছুতেই কারখানার খরচ বৃদ্ধির পন্থা হতে দেয়া উচিত নয়। প্রকৃত খরচাদির পর কারখানার লাভের একটি যুক্তিসংগত অংশ বোনাস হিসেবে শ্রমিকদের দেয়া উচিত। আইনে তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকা দরকার। এভাবে শ্রমিকদের শোষণের যত পন্থা আছে সব বন্ধ করে দিতে হবে।
কেননা আল্লাহ জুলুম ও জালেমকে পছন্দ করেন না। বাংলাদেশের মতো কিছু মুসলিম দেশে কৃষি শ্রমিকরা নানাভাবে শোষিত হচ্ছে । গ্রামের জনসাধারণের এক বিপুল অংশ ভূমিহীন অথবা প্রায় ভূমিহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। দুর্ভিক্ষ ও অন্যান্য দুর্যোগে তাদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
ক্ষেত তৈরি ও ফসল কাটার মওসুমে তারা মোটামুটি মজুরি পেয়ে থাকে। অন্যান্য মওসুমে তাদেরকে অত্যন্ত কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হতে হয়, কেননা তখন কাজের অভাব থাকে। এ অবস্থার আসল প্রতিকার নিশ্চয়ই কাজ সৃষ্টি করার মধ্যে রয়েছে । সেজন্য অবশ্য এসব দেশের সরকারকে যথাযোগ্য পদক্ষেপ নিতে হবে।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ইসলামী সরকারের উচিত হবে কৃষি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য তাদের নিম্নতম মজুরি বেঁধে দেয়া ৷ আইন করেই তা করতে হবে। আইন ছাড়া এ অবস্থার সংশোধন করা সম্ভব নয় । মজুরি নির্ধারণ অবশ্য বাস্তবতার আলোকেই করতে হবে । অবাস্তব মজুরি নির্ধারণ করা হলে কৃষি শ্রমিক হয়ত বা একেবারেই কাজ পাবে না।
তাতে অবস্থার আরো অবনতি হতে পারে। কাজেই তাদের নিম্নতম মজুরি ফসলের মওসুমে কিছুটা বেশি ও অন্য সময়ের জন্য কিছু কম ধার্য করা যেতে পারে । এজন্য স্থায়ী মজুরি কমিশনকে দায়িত্ব দিতে হবে। বাস্তব অবস্থা ও অভিজ্ঞতার আলোকেই তারা এসব মজুরি নির্ধারণ করবেন। সময় সময় সে মজুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যালোচনা করতে হবে।
দোকান কর্মচারীরাও অস্বাভাবিক পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়। তাদের বারো ঘণ্টার বেশি পরিশ্রম করতে হয়। এটা কিছুতেই ইনসাফ হতে পারে না কেননা এটা স্বাস্থ্যসম্মত নয় । তাদের অসুবিধা লাঘব করার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি । দোকান কর্মচারীদের জন্য কাজের শিফট ব্যবস্থা চালুর চিন্তা করা যেতে পারে।
খুব ছোট দোকানে সম্ভব না হলেও বড় বড় দোকানের জন্য তা করা নিশ্চয়ই সম্ভব। কর্মে নিযুক্ত জনশক্তির একটি বিরাট অংশ হচ্ছে এই দোকান কর্মচারী। কাজেই তাদের যথার্থ অধিকারের ব্যবস্থা করা ইসলামী সরকারের বিশেষ দায়িত্ব হওয়া উচিত।
অন্যান্য শ্রমিকদের মতো অবশ্য তাদের নিম্নতম বেতনও কমিশনকে বাস্তবতার আলোকে নির্ধারণ করে দিতে হবে। সরকারি কর্মচারীদেরকে ন্যায়সংগত মজুরি দেয়া সরকারের বিশেষ কর্তব্য হবে। গৃহকর্মীদের স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থাও আইনে থাকতে হবে।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
দারিদ্র্য দূরীকরণ
সমাজ হতে দারিদ্র্য দূর করা ইসলামী সরকারের অন্যতম দায়িত্ব, কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে, দারিদ্র্য মানুষকে কুফরের দিকে নিয়ে যেতে পারে । এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, দারিদ্র্য মুসলমানদের এক বিরাট অংশকে ইসলামের মূল দাওয়াত বুঝা, গ্রহণ করা ও কার্যকরী করার প্রচেষ্টা থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে।
তারা এত সমস্যায় জর্জরিত যে, ইসলামী আদর্শবাদের কথা চিন্তা করতেও সময় পায় না । কাজেই সব উপায়ে মুসলিম বিশ্ব হতে দারিদ্র্যকে উৎখাত করতে হবে। এজন্য মুসলিম সরকারসমূহকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। দারিদ্র্যকে এক নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
বেকার জনশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। বেকার সমস্যার সার্বিক সমাধান অবশ্য অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়নের উপর নির্ভর করে। এ জন্য সরকারকে সরকারি ও বেসরকারি অর্থনৈতিক উদ্যোগকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইসলামী সরকারের ভূমিকা যে কোনো গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক সরকার অপেক্ষা বেশি হওয়া উচিত। বেকার সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে সাময়িক কাজেরও ব্যবস্থা করতে হবে।
সে জন্য বেকার জনসংখ্যাকে তালিকাবদ্ধ করে কর্মীবাহিনী (Work Brigade) গড়ে তুলে নদী খোদাই, খাল খনন, বাঁধ নির্মাণ, নদীর বাঁক কাটা, রাস্তাঘাট নির্মাণ, সেচ প্রকল্প ইত্যাদি বড় বড় কাজ করে নেয়া যেতে পারে।
অসহায় বৃদ্ধ, পঙ্গু, অসুস্থ শিশু ও বিধবা যারা খেটে খেতে পারে না তাদের পুনর্বাসনের জন্য অবশ্য আলাদা উদ্যোগ নিতে হবে। ইসলামী সরকারকে এজন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যাকাতকে কায়েম করতে হবে। যাকাতের অর্থ দিয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক এতিমখানা, মহিলা ও বৃদ্ধ পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
তাদের ভরণপোষণের খরচও যাকাত হতে মেটাতে হবে। এসব লোকের মধ্যে যাদের আবাস রয়েছে, তাদের অবশ্য ভাতা দিলেই চলবে । যেসব অভাবী বেকারকে কাজ যোগাড় করে দেয়া যাবে না তাদেরকেও ভাতা দিতে হবে।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
যাকাত কায়েম
যাকাত কায়েম করা সরকারের জন্য অপরিহার্য। যাকাত যে সরকারি পর্যায়ে কায়েম করতে হবে তার একটি বড় দলিল কুরআনে যাকাতের ব্যয়ের খাত হিসেবে যাকাত কর্মচারীদের উল্লেখ।
(সূরায়ে তওবা: আয়াত ৬০, ১০৩)
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কয়েক’শ বছর যাবত যাকাত কায়েম না থাকায় নতুন করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যাকাত ব্যবস্থা কায়েম করা নিঃসন্দেহে কিছুটা জটিল হবে। এজন্য ইজতিহাদের প্রয়োজন । একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি কায়েম করে আধুনিক আইনের সাহায্য নিয়ে বর্তমানের উপযোগী একটি যাকাত বিধি (Zakat Act) তৈরি করতে হবে।
শিল্পের জাতীয় নিয়ন্ত্রণ
ইসলামী সরকারকে যদি বেকারত্ব ও অভাব দূর করতে হয়, তবে তাকে ব্যাপক অর্থনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আজকের যুগে কেবল বেসরকারি উদ্যোগের উপর নির্ভর করলে সমস্যার সমাধান হবে না। এজন্য সরকারি খাতে ব্যাপক শিল্প স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া সরকারের কর্তব্য।
এজন্য প্রথমত মূল শিল্পের দিকে নজর দেয়া উচিত, কেননা মূল শিল্পগুলো গড়ে তুলতে বেসরকারি উদ্যোগের খুবই অভাব হয়ে থাকে । অথচ এসব শিল্প গড়ে তোলা জাতির জন্য অপরিহার্য। অন্য কথায়, এটা হচ্ছে সরকারের পক্ষ হতে ‘ফরজে কেফায়া’র দায়িত্ব পালন।
বর্তমান যুগে একটি মুসলিম দেশের মূল ও প্রধান শিল্প রাষ্ট্রের হাতেই থাকা উচিত। এ বিষয়টি নির্ভর করে সময়, পরিস্থিতি ও অভিজ্ঞতার উপরে। বেসরকারি উদ্যোগ কিছুটা দক্ষ সন্দেহ নেই, কিন্তু তারা প্রায়ই সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে থাকে, যা হচ্ছে জনগণের পাওনা।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
তারা মালের চড়া মূল্য আদায় করে এবং ভেজাল ও অবৈধ ব্যবসা পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, জনগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বড় শিল্পপতিদের জুলুমের শিকার হয়েছে।
কাজেই সব কিছু বিবেচনা করে প্রধান শিল্পগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখাই সংগত হবে। শরীয়তের দৃষ্টিতেও এটি নিঃসন্দেহে সম্পূর্ণ বৈধ। আমরা জানি যে ইসলামী রাষ্ট্র পানি, খনি, বন-জঙ্গল, চারণভূমি ইত্যাদির উপর ব্যক্তি মালিকানা স্বীকার করে না।
এসব সম্পদ ব্যক্তি মালিকানায় দেয়া হলে সর্বসাধারণের অধিকার নষ্ট হতো এবং জনগণ কষ্টের সম্মুখীন হতো। শরীয়তের সিদ্ধান্ত হতে আমরা এ নীতি পাচ্ছি যে, যেসব সম্পদ ব্যক্তি মালিকানায় অর্পিত হলে জনগণের স্বার্থ নষ্ট হয় অথবা জনগণ অসুবিধার সম্মুখীন হয় তা ব্যক্তি মালিকানায় থাকা কিছুতেই সঠিক নীতি হতে পারে না।
এজন্য অতীত ইসলামী অর্থনীতিবিদদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যেসব সম্পদ সাধারণভাবে সকল মুসলমানের জন্য অত্যাবশ্যকীয় তা কারো ব্যক্তিগত মালিকানায় দান করার অধিকার রাষ্ট্রপতির নেই।
কাজেই যেসব সম্পদ কারো ব্যক্তিগত মালিকানায় ছেড়ে দিলে সর্বসাধারণের কষ্ট বা অনিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তা সবই রাষ্ট্রীয় অথবা সার্বজনীন মালিকানায় রাখতে হবে।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
বেসরকারি মালিকানায় যেসব ব্যবসা ও শিল্প সুফল না দিয়ে বরং জাতির সমূহ ক্ষতি করেছে বলে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, সেসব শিল্প ও ব্যবসা জাতীয় মালিকানায় নিয়ে নেয়াই সঠিক ও জনকল্যাণকর পদক্ষেপ হবে।
অবশ্য কোন কোন শিল্প ও ব্যবসাকে জাতীয় মালিকানায় নেয়া জাতীয় কল্যাণ ও জুলুম বন্ধ করার জন্য জরুরি তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব ইসলামী সরকারের পার্লামেন্টের। তবে ক্ষতিপূরণ না দিয়ে কোনো বৈধ মালিকানাই সরকার হরণ করতে পারবে না। জাতীয় মালিকানার ধরনও নানারকম হতে পারে।
সরকার একাও মালিক হতে পারে অথবা জনগণের হাতে মালিকানার একটি অংশ শেয়ারের আকারে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম করা যেতে পারে না। এ বিষয়টি নির্ভর করবে প্রয়োজন, পরিবেশ, সময়, পরিস্থিতি ও অভিজ্ঞতার উপরে ।ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।
এ যুগে ইসলামী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হবে সুদবিহীন অর্থনীতির পুনঃপ্রবর্তন । সুদকে নির্মূল করা ইসলামের একটি প্রধান লক্ষ্য । বিশাল ইসলামী খেলাফত হতে সুদকে নির্মূল করা হয়েছিল এবং সুদ ছাড়াই অষ্টম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সে যুগের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাষ্ট্র আব্বাসী খেলাফতের অর্থনীতি পরিচালিত হতো। আজও তা সম্ভব।
ইসলামী সরকারের প্রধান দায়িত্বসমূহ এ প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে । এ সরকারের অন্য অনেক অর্থনৈতিক ও অন্যান্য দায়িত্ব রয়েছে। ইসলামী আইন ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে সরকারকে সেসব দায়িত্ব পালন করতে হবে। ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা।